প্রাসঙ্গিক লেখাঃশিবিরের ক্রান্তিকালঃ ১৯৮২ সালের কথকতা
একটা ঘটনা দিয়ে আজকের লেখা শুরু করতে চাই।
বিরাট ওয়াজ মাহফিল। ওয়াজ করছেন মাওলানা আশরাফ আলী থানভী। হঠাৎ একজন তাঁর হাতে একটি চিরকুট এনে দেয়। চিরকুট হাতে নিয়ে তিনি প্রথমে নিজে পড়লেন, পরে সবাইকে পড়ে শোনালেন। চিরকুটে লেখা, ‘তুমি কাফের, তুমি মুর্খ, তুমি সাবধানে কথা বলো।’
এর পর বললেন, ‘কালেমা পড়ার পর কেউ আর কাফের থাকে না। সে মুসলমান হয়ে যায়। একজন আমাকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছেন। আমি আপনাদের সবার সামনে কালোমা পড়ছি। লা ইলাহা ইল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আগে কাফের থাকলেও এখন আমি মুসলমান।’
‘তিনি বলেছেন, আমি মুর্খ। তিনি ঠিকই বলেছেন। আমার কোন জ্ঞান নেই। আমি যা বলি তা কুরআন-হাদিস থেকে আল্লাহ এবং রাসুল (স) যা বলেছেন তা-ই বলি। এখানে আমার কোন কৃতিত্ব নেই।’
‘তিনি বলেছেন, সাবধানে কথা বলো। আমি এমনিতেই সাবধানে কথা বলি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমার সব কথা ফেরেশতারা লিখে রাখছেন। কেয়ামতের দিন সকল কথার জন্যে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আপনার নসিহতের পর আমি আরো সাবধানে কথা বলবো।’
আমি মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর এ কথাগুলো মনে রাখার চেষ্টা করি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রথম এবং তৃতীয় জবাবটি খুব প্রাসঙ্গিক। কেউ আমাকে গোমরাহ বা ইসলাম থেকে খারিজ করে দিলে তওবা করে কালেমা পড়ে নিয়ে ভাবি, আমাকে কথা বলা এবং লেখার ব্যাপারে আরো সাবধান হতে হবে।
৮২ সালের কথকতা পড়ে কেউ কেউ হয়তো কষ্ট পেয়েছেন। কারো কারো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে তা বোঝা যায়। আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাই। কাউকে কষ্ট দেয়ার জন্যে এ লেখা নয়। এ লেখা কাউকে প্রমোট করার জন্যেও নয়। কারো আত্মত্যাগ-অবদানকে ছোট করে দেখা অথবা কোন দায়িত্বশীলকে হেয় বা অবমূল্যায়ন করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
লেখা প্রকাশিত হবার পর এ ব্যাপারে অসংখ্য প্রশ্ন এসেছে। সকল প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। আমি ততটুকু-ই জানি যা আমার সামনে ঘটেছে এবং তা-ই বর্ণনা করেছি। এর বাইরে খুব একটা তথ্য আমার কাছে নেই। অসংখ্য মানুষ আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। যারা যোগাযোগ করেছেন তাদের মধ্যে বৃটেনসহ বাংলাদেশ, কানাডা, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে বসবাসকারী মানুষ রয়েছেন। অধিকাংশ মানুষ লেখাকে স্বাগতঃ জানিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, শেষের দিকে এসে মনে হয়েছে আমি তাড়াহুড়া করছি। আরো লেখার প্রয়োজন ছিল। আমি স্বীকার করি, হয়তো আরো অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ ছিল। সময়ের সীমাবদ্ধতা, তথ্য-উপাত্তের অনুপস্থিতি এবং উৎসাহের অভাবের কারণে এমনটি হয়েছে।
কিছু পাঠক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ অশোভন ভাষায় আমার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন। উল্লেখিত তথ্য সম্পর্কে কোন পাল্টা তথ্য উপস্থাপন না করে নানা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে বালখিল্যতা দেখিয়েছেন। কেউ বলেছেন, এ লেখার মাধ্যমে আমি অপরাধ করেছি। সে জন্যে তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসতে হবে। নতুবা আমাকে এ জন্যে দুনিয়া এবং আখেরাতে ক্ষতির সম্মূখীন হতে হবে। আরো বহু ধরণের নসিহত আমার প্রতি বর্ষিত হয়েছে। তওবা করার ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই। প্রত্যহ কমপক্ষে দু বার এবং সুযোগ পেলে কয়েকবার আমি তওবা করি। পাঠকের দেয়া নসিহত অনুসরন করে আবার তওবা করছি। হে আল্লাহ! জেনে না জেনে ছোট-বড় যত অপরাধ করেছি, তুমি তা মাফ করে দাও এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার পথে অটল থাকার তওফিক দাও।
যারা পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাদের সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। পাঠকদের প্রশ্ন ও মন্তব্য থেকে আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পেরেছি, নতুন বিষয় অনুধাবন করেছি। আমার লেখায় যাদের নাম এসেছে তাদের কারো প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই। ঘটনা বর্ণনার প্রয়োজনে তাদের নাম এসেছে মাত্র। যারা আমার প্রতি অশোভন আচরণ করছেন তারা হয়তো মহৎ উদ্দেশ্যে সেটা করছেন। আমি যদি তাদের মতো চিন্তা করতাম এবং তাদের অবস্থানে থাকতাম তা হলে আমিও হয়তো একই ধরণের আচরণ করতাম। তবে উদ্দেশ্য মহৎ হলেই কোন কাজ সঠিক হয়ে যায় না। ইসলামের দৃষ্টিতে কাজের পদ্ধতিও সঠিক হতে হবে। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাদের অপরাধ সমূহ ক্ষমা করেন এবং সৎকর্মসমূহ কবুল করেন।
আমি যে বিষয় নিয়ে লিখেছি সে বিষয় সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম সরাসরি অবহিত নয়। ঘটনা ঘটেছে ৩৩ বছর আগে। সে সময় যারা জড়িত ছিলেন তারা বলতে পারেন, আমি ঠিক বলছি না ভুল বলছি। আমি মানুষ, ফেরেশতা নয়। আমার ভুল হতে পারে, আমার ভুল হয়। জীবনে বহু ভুল করেছি। আমার আশা ছিল, আমার লেখায় ভুল তথ্য থাকলে প্রত্যক্ষদর্শীর রেফারেন্স বা বিকল্প তথ্য দিয়ে কেউ তা খন্ডন করবেন। সে সময়ের কার্যকরী পরিষদের অনেক সদস্য মাঠে-ময়দানে আছেন। তাদের সাথে আলোচনা করে প্রদত্ত বিবরণ যাচাইয়ের সুযোগ আছে। কিন্তু কেউ তা করতে এগিয়ে এসেছেন বলে আমার চোখে পড়েনি। তথ্য খন্ডন না করে আজে-বাজে মন্তব্য করলে ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যায় না। তা ছাড়া কেউ বিজয়ী অথবা শক্তিশালী হবার অর্থ এ নয় যে প্রতিপক্ষের যুক্তি বা তথ্য ভুল ছিল। যুগে যুগে, দেশে দেশে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস অতীতে অনেক হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা কখনো ফলপ্রসু হয় না। একদিন সত্য আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। আমাদের জানা ইতিহাস তাই বলে।
আমার লেখা পাঠ করে যারা অশোভন ভাষা ব্যবহার করেছেন তাদের নিকট থেকে আমার জন্যে শিক্ষনীয় দিক রয়েছে। আমি যদি আরো মধুর ভাষায় লিখতে পারতাম, আরো যৌক্তিক ভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে পারতাম তা হলে হয়তো তারা অশোভন ভাষা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতেন। তাদের ভাষা থেকে আরেকটা জিনিস আমি বুঝেছি। গত ১২ বছর আমি বাংলাদেশে যাইনি। অন্যান্য দলের অনেকের কাছ থেকে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আমার কাছে আসে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে পড়াশোনার পরিধি এবং আচরণ। আমি ভাবতাম, ওরা বিরোধিতার খাতিরে তা বলছে। এখন তাদের ভাষা এবং বক্তব্য দেখে বুঝতে পারছি, উত্থাপিত অভিযোগের সবটুকু বানানো নয়। তাদের পড়াশোনা খুব সীমিত এবং কারো কারো আচরণ থেকে পরিস্কার বোঝা গেছে, তারা ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না।
‘মানুষের সাথে সুন্দর করে কথা বলো’ – এটা কুরআনের নির্দেশ। নবী মুসা (আ) এবং তাঁর ভাই হারুন (আ) কে আল্লাহ ফেরাউনের মতো খোদাদ্রোহীর কাছে গিয়ে দাওয়াত দিতে নির্দেশ দেন। সেখানে বলে দেন, ‘তার সাথে তোমরা নম্র ভাষায় কথা বলবে।’ সুতরাং কোথাও কেউ দোষ করলে নরম ভাষায় বলা ইসলামী আচরণের দাবি। মহানবী (স) বলেছেন, ‘মানুষের জন্যে সহজ করো, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, মানুষের মধ্যে বিরক্তি সৃষ্টি করো না।’
আমি আগেও বলেছি, এটা আমার আত্মকথা। এর আগেও আত্মকথা লিখেছি। সেটা ছিল কিশোর বয়সের কথা। ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে। আমার ওয়েব-সাইটে আছে। আলোচ্য লেখার নাম ছিল ‘৮২ সালের অকথিত কথকতা’। এক বন্ধু বললেন, শিবিরের নামটা যোগ হলে পাঠক বুঝবে আপনি কোন প্রসঙ্গে কথা বলছেন। ’৮২ সালের সংকট নিয়ে লেখার জন্যে অতীতে দেশ-বিদেশের অনেক বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীর পক্ষ থেকে আমার কাছে বার বার অনুরোধ এসেছে। আমি এতদিন তাদের কথায় কান দেইনি। লেখাটি অনেক আগে তৈরি হলেও নানা দিক বিবেচনা করে এতদিন প্রকাশ করিনি।
লেখা পাঠ করে অনেকে এর পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন। র (RAW) এবং মোসাদকে টেনে আনছেন। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বাংলাদেশী মানুষের প্রিয় প্রসঙ্গ। ইসলামী ঘরাণার লোক এর ব্যতিক্রম নয়। এর আগে আমরা মাওলানা আব্দুর রহীম সম্পর্কে শুনেছি, তিনি সিআইএ’র দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধির সাথে বৈঠক করেছেন। ভিন্নমতের লোকদের ব্যাপারে ‘র’ কানেকশনের কথা ইতোপূর্বেও প্রচার করা হয়েছে। আহমদ আব্দুল কাদের সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। আমার সম্পর্কে এতোদিন কিছু শুনিনি, এ লেখা প্রকাশের পর বলা শুরু হয়েছে।
আমি জানি আমি কেন লিখেছি এবং যা লিখেছি জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী সত্য লিখেছি। আমরা দেখেছি, ৮২ সালে নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিল একই ধরণের সংকট পরবর্তীতেও হয়েছে। তাই বিষয়টা নিয়ে পর্যালোচনা হওয়া সময়ের দাবি বলে আমি মনে করি। এ প্রেক্ষিতেই এ সকল বিষয় এসেছে। কেউ চাইলে যারা সে সময় জড়িত ছিলেন তাদের নিকট থেকে এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখতে পারেন। আমার বিবরণ বিশ্বাস করা বা না করা পাঠকদের বিষয়। কাউকে আমার কথা বিশ্বাস করার জন্যে বাধ্য করার অধিকার বা ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমার লেখার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যারা বাজে এবং অশালীন মন্তব্য করছেন সে দায়িত্ব তাদের। আমি বিশ্বাস করি, আমার ভাষা আমার পরিচয় বহন করে, তাদের ভাষা তাদের।
কেন আমি ৮২’র সংকট নিয়ে লেখার জন্যে বর্তমান সময় বাছাই করেছি, এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের উল্লেখ করে কোথাও কোথাও ‘ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইলিং’ চলছে। রাজনৈতিক সংকটের কথা বলে যে কোন ইসলাম-পছন্দ ব্যক্তিকে প্রভাবিত করা সম্ভব। এটা ঠিক, মানুষ যখন হত্যা, নির্যাতন, গুম এবং জুডিসিয়াল কিলিং এর মুখোমুখি তখন এ সব পুরাতন কথা শুনতে কারো ভালো লাগার কথা নয়। যারা আমার কাছাকাছি আছেন এবং যাদের সাথে আমার অন-লাইন যোগাযোগ আছে তারা ভালো করেই জানেন, চলমান নির্যাতন ও জুডিসিয়াল কিলিং এর কারণে আমার অশ্রুপাত ও রক্তক্ষরণ কারো থেকে কম নয়। কিন্তু এ সংকটের কারণ কী তা আমাদের অন্বেষণ করা দরকার। ধামাচাপা বা গলাবাজি নয়, সত্যিকার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করছি, সংকট সৃষ্টির কারণ এবং তা থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া অন্বেষণ শুরু হয়েছে। আমার এ আলোচনা সংকট উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
৭১ নিয়ে আমি আজ হঠাৎ করে আলোচনা শুরু করিনি। ৮২’র আগে এবং পরে অনেক আলোচনা করেছি। সিলেট থেকে প্রকাশিত এবং মুকতাবিস-উন-নূর সম্পাদিত সাপ্তাহিক সিলেট কন্ঠে ’৮২ সালের শেষের দিকে একবার এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য লিড-নিউজ হিসেবে ছাপা হয়েছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সুরমায় ২০০৩ সালে এ বিষয়ে আমার লেখা ছাপা হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে অনেক অন-লাইন আলোচনাও আছে। এ প্রসঙ্গে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ড. আব্দুস সালাম আজাদী তাঁর ফেইস-বুক স্ট্যাটাসে খুব সুন্দর একটা মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘
মুহতারাম ফরিদ আহমাদ রেজা ভাইকে আমাকে একসময় ঘৃণা করতে শেখানো হয়েছিল। কারণ তারা শিবিরকে ভেঙ্গেছেন। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠতায় আসার পর মনে হয়েছে, যারা তাকে শিবির ভাঙ্গার অপবাদ দিয়েছিলো, যারা বলতো তিনি আর ইসলামে নেই, তারা অনেক ভুল কথা বলেছেন। ইদানিং তিনি ১৯৮২ এর শিবিরের ক্রান্তি কাল নিয়ে লিখছেন, আমার মত অনেকে কৌতুহলি হলেও বেশ কিছু তরুণ অতরুণ তাকে নিয়ে বিষোদ্গার করছেন। আমি বলি এই সব কথা আসা ভালো। ইসলামি আন্দোলনে এখন নতুন মোড়ের সময়, এই সময়ে আমাদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে পা না বাড়াতে পারলে আমাদের গর্তগুলোতে আবারো আমরাই পড়তে পারি। আমাদের মত মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারিরা যদি আমাদের ই একজনের কথা সইতে না পারি……………!!!’
আমার লেখার ব্যাপারে অনেক অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এসেছে। এটা লেখার উদ্দেশ্য, আমার ব্যক্তিগত কাজ-কর্ম, ভাষার ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনার সাথে সাথে অনেক আপত্তিকর মন্তব্য এসেছে। এ সব প্রশ্ন বা মন্তব্যের জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
৭১ এবং যুবশিবির নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং মূল্যবান মন্তব্য এসেছে। কেউ কেউ কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। আরেকটা মৌলিক প্রশ্ন, ৮২ সালে সংকট সৃষ্টির কারণ কী? এ সকল প্রশ্নের কোনটাই এমন নয় যে এক কথায় বা সংক্ষেপে জবাব দেয়া যায়। প্রত্যেকটির ব্যাপারে স্বতন্ত্র আলোচনার প্রয়োজন। ৭১ প্রসঙ্গে শিবিরের কার্যকরী পরিষদের বৈঠকে এ নিয়ে কোন পর্যালোচনা হয়েছিল বলে আমি জানি না। আমার উপস্থিতিতে কোন মতবিনিময়ও হয়নি। ময়দানে কাজ করতে গিয়ে আমরা বুঝেছি, ৭১ ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটা সিদ্ধান্ত নেয়া সময়ের অনিবার্য দাবি। শুরু থেকেই ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বলিষ্ঠভাবে কথা বলছি। আমরা বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন করি। কিন্তু ৭১ সালে জামাতের ভূমিকা নিয়ে ময়দানে আমরা কিছু বলতে পারি না। জামাতের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে লিখিত বা অলিখিত কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই।
অপরদিকে স্বাধীনতার পর থেকে মাঠে-ময়দানে এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে একতরফা ভাবে ৭১ ইস্যু নিয়ে জামাতের বিরুদ্ধে প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে। এর প্রেক্ষিতেই বিষয়টা আলোচনায় এসেছে। জামাত রাজনৈতিক ভাবে অখন্ড পাকিস্তানের সমর্থক ছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল, এটা কোন গোপন বিষয় ছিল না। কিন্তু কেন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল তা কখনো পরিস্কার করে বলা হয়নি। আমাদের দাবি ছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিষয়টা নিয়ে পর্যালোচনা করা দরকার। পর্যালোচনা করে যদি জামাত মনে করে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল তা হলে এর কারণসহ তা জনগণের সামনে পেশ করতে হবে। যদি দেখা যায়, সে সিদ্ধান্ত ভুল ছিল তা হলে তাও জনগণকে অবহিত করতে হবে। যে কোন বিচারে এ দাবির যৌক্তিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।
৭১-এর ব্যাপারে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গঠন, দায়িত্বশীল নিয়োগ, প্রশ্নপত্র তৈরি ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক কথা ময়দানে চালু আছে। কিন্তু এ মুহূর্তে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্য দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ২০০৬ সালে ‘পলিটিক্স এন্ড ডেভেলাপমেন্ট অব দ্যা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ (BD-ISBN:984-8360-17-4) নামক একটি বই বাজারে এসেছে। বইয়ের লেখক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ভূইয়াঁ মনোয়ার কবির। এর প্রকাশক এ এইচ ডেভেলাপমেন্ট পাব্লিশিং হাউস, ঢাকা। এ বইয়ে এ ব্যাপারে রেফারেন্স সহ আলোচনা করা হয়েছে। আগ্রহীরা বইটি পড়ে দেখতে পারেন। আগ্রহী কেউ প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে এ ব্যাপারে গবেষণা করতে পারেন।
২০০৩ সালের জুলাই মাসে লন্ডনের সুরমা পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখায় বলেছিলাম, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে বাংলাদেশের অধুনিক প্রজন্মের সাথে ইসলামী আন্দোলনের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে এরও একটা সমাধান হওয়া দরকার। শুধু বিজয় স্মৃতিস্তম্ভে ফুলদান করে সে দূরত্ব দূর করা যাবেনা। মরহুম খুররম মুরাদ তরজমানুল কুরআনে (জানুয়ারী, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ১৫-১৬) প্রকাশিত তার জীবনের সর্বশেষ লেখায় এ প্রসঙ্গ খুব সুন্দরভাবে অবতারণা করেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, জনগণের সাথে এবং জনগণের জন্য যারা কাজ করেন তাদের উচিত নিজেদের ভুল সিদ্ধান্ত বা ভুল কাজ গোপন না করে অথবা এর ভিন্ন ধরণের ব্যাখ্যা না দিয়ে প্রকাশ্যে জনগণের সামনে ভুলের স্বীকৃতি দেয়া। এর ফলে জনগণের সামনে তাদের সম্মান হ্রাস না পেয়ে আরো বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, খুররম মুরাদ বহু বছর ঢাকায় বাস করেছেন এবং ৭০-৭১ সালেও ঢাকায় ছিলেন। তখন তিনি ঢাকা শহর জামাতে ইসলামীর আমীর ছিলেন।
আমার মতে, পাক-বাহিনীর সাথে সহযোগিতার বিষয়টি ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন ফোরামে পর্যালোচনা হওয়া সময়ের দাবি এবং সে পর্যালোচনা জনসমক্ষে আসা দরকার। মহানবীর (সঃ) সমসাময়িক কোনো কোনো কাজের পর্যালোচনা কুরআনে খোলাখুলিভাবে এসেছে এবং তা কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। এতে মহানবী (স:) বা সাহাবাদের মর্যাদা কিছুমাত্র ক্ষুন্ন হয়নি।’
যুব শিবির গঠন, সময়কাল, এর যৌক্তিকতা, পরিধি, কর্মকৌশল, কেন যুবশিবির খেলাফত আন্দোলনের সাথে একীভূত হলো ইত্যাদি ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে। আমি যুব শিবিরের কেউ-কেটা ছিলাম না। সংগঠনের দৈনন্দিন কাজের সাথেও জড়িত ছিলাম না। যারা এটা গঠন করেছেন তারাই এ সকল প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। যুব শিবির প্রতিষ্ঠার যৌক্তিতা ব্যাখ্যা করা বা যুবশিবিরকে প্রমোট করা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি শুধুমাত্র নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ঘটনাবলীর একটা বিবরণ উপস্থাপন করেছি।
৮২ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যুব শিবিরের আলোচনা আসতে বাধ্য। যুবশিবির নিয়ে যে সকল প্রশ্ন এসেছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাকে আরো পড়াশোনা করতে হবে এবং গঠন প্রক্রিয়ায় যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তাদের সাথে আলোচনা করতে হবে। কিন্তু তা করার সময় বা আগ্রহ কোনটাই আমার নেই। যে কেউ তা করতে এগিয়ে আসতে পারেন। আমি যেটা জানি তা হলো, শিবিরের প্রাক্তন নেতৃবৃন্দ একটা যুব-সংগঠন গঠনের চিন্তা অনেক আগে থেকেই করছিলেন। পাঠকদের মনে থাকবে, শিবিরের প্রাক্তন সভাপতি মাওলানা আবু তাহেরের সাথে আলোচনার সময় আমি সে কথা তাঁকে বলেছি। আমার মতে, ৮২’ এর সংকট ভিন্ন কাঠামো দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করেছে মাত্র।
আমার মনে হয় এখানে আরেকটি কথা পরিস্কার করা দরকার। আমার বিভিন্ন লেখায় বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ থাকলেও বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
লন্ডন, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫