প্রশ্ন উঠতে পারে, এতোদিন পর এ সকল পুরানো কথা আলোচনার কী কোন প্রয়োজন আছে? আমার মতে অন্য কোন প্রয়োজন না থাকলেও ইতিহাসের একটা দায় আছে। সে দায় মুক্তির খাতিরেই এর অবতারনা।
৮২ সালের কোন এক সকাল। চায়ের বাক্স রিক্সায় তুলে সে বাক্সের উপর আমি উঠে বসলাম। রিক্সা চালককে বললাম, ‘চলো চলো, বন্দর চলো।’ বন্দর মানে বন্দর বাজার, সিলেট শহরের আদি ব্যবসা-বানিজ্যের কেন্দ্রস্থল।
ঢাকা থেকে সিলেট এসেছি। সদ্য বিয়ে করেছি। চাকরি নেই। টাকা পয়সা নেই। যারা এক সময় খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল তারাও এখন ঘনিষ্ট নয়। এক বন্ধু আবদুল কাইয়ূম। আরেক বন্ধু মকবুল আহমদ। এ দু জন সাহায্যের হাত প্রসারিত করলেন। তাদের সাহায্য ছাড়া সিলেট শহরে আমার দাঁড়াবার ঠাঁই হতো না। আল্লাহ তাদের ভালো কাজের পুরস্কার দিবেন। মকবুল আহমদের স্ত্রী মনোয়ারা আহমদের বড় ভাই মোহাম্মদ ফারুক মৌলভীবাজার শহরে চায়ের ব্যবসা করেন। মোহাম্মদ ফারুক চট্রগ্রাম থেকে নিলামে চা খরিদ করে আনেন। তিনি খরিদমূল্যে আমাকে চা সরবরাহ করতে সম্মত হলেন। আব্দুল কাইয়ূম দিলেন ব্যবসার পুজি। আম্বরখানা বাজারে একটা দোকান ভাড়া নিয়ে চা ব্যবসা শুরু করলাম। চা ব্যবসা মানে চয়ের দোকান নয়, চা-পাতার দোকান। সিলেট শহরে তখন বন্দর বাজার, মহাজনপট্টি এবং কালিঘাট ছিল ব্যবসার কেন্দ্র।
ফুট ফরমায়েশ এবং আমার অনুপস্থিতিতে দোকানে বসার জন্যে সামান্য বেতনে একটি ছেলে রাখলাম। ছেলেটির নাম বাবুল। বড়াপার পেছনের বাসায় থাকে, ভালো পরিবারের ছেলে। ফারুক ভাই নিলামে চা কিনে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। ১৫/২০টা চায়ের বাক্স এক সাথে পাঠাতেন। কয়েকটা বাক্স খুলে পলিথিনের প্যাকেট করে দোকানে সাজিয়ে রাখতাম খুচরা বিক্রির জন্যে। বাকিগুলো বন্দরবাজার, কালিঘাট এবং মহাজনপট্টির কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে অল্প লাভে বিক্রি করে দিতাম। তাদের কাছে চায়ের বাক্স রিক্সায় করে নিজেই নিয়ে যেতাম। কোন সময় বাবুলকে দিয়ে পাঠাতাম। চায়ের বাক্সের উপর বসে বন্দর বাজার, মহাজনপট্টি এবং কালিঘাটে চক্কর দেয়া প্রতি মাসের কাজ ছিল।
সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটতো। অপেক্ষা করতাম কখন সন্ধ্যা হবে। সন্ধ্যার পর ছোট্ট চায়ের দোকানে বন্ধুদের অনেকে আসতেন। তরুণ সাহিত্যকর্মীদের সাথে মুরব্বীরাও আসতেন। স্বানমধন্য গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দর আলী আসতেন। সিলেট আলীয়ার উস্তাদ মাওলানা জহুর আহমদ আসতেন। প্রায়ই আসতেন দুজন প্রিয় বন্ধু হারুনুজ্জামান চৌধুরী এবং আব্দুল হামিদ মানিক। দোকান বন্ধ করে বেরিয়ে পড়তাম তাদের সাথে আড্ডা দিতে। কখনো যেতাম চায়ের দোকানে গরম পিয়াজু অথবা হারুনুজ্জামান চৌধুরীর প্রিয় শিক কাবাব খেতে। কখনো যেতাম বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে। আব্দুল হামিদ মানিক তখন চাকরি করতেন মুকতাবিস-উন-নূরের সম্পাদনায় প্রকাশিত সিলেট কন্ঠে। হারুনুজ্জামান চৌধুরীছিলেন সাপ্তাহিক জালালাবাদ’র সম্পাদক। প্রধানতঃ এ দুটি পত্রিকার অফিসেই আমরা যেতাম। বাসায় ভালো খাবার থাকলে মাঝে মাঝে দু জনকে নিয়ে বাসায় চলে আসতাম।
সিলেট শহরে আমি অপরিচিত ছিলাম না। দীর্ঘদিন এ শহরে থেকে লেখাপড়া করেছি। রাস্তায় মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছি, বন্দর এবং কোর্ট পয়েন্টে বক্তৃতা করেছি। সাহিত্য সভায় কবিতা পড়েছি, সুধী সমাবেশে আলোচনা রেখেছি। শহরে অনেক বন্ধু, অনেক আত্মীয়-স্বজন এবং অনেক পরিচিত জন রয়েছেন। আমার অবস্থা দেখে কেউ মুখ টিপে হাসতো। কেউ রিক্সা থামিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করতো। কেউ হঠাৎ দেখে চমকে উঠতো। বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করতো, ‘রেজা ভাই? কবে এলেন?’
বলতাম, ‘আসিনি, আছি।’
– কোথায় আছেন?
– শাহী ঈদগাহ, সৈয়দ পুর হাউস।
– নিজের বাসা?
– না, দুলাভাইয়ের বাসা। তবে সৈয়দ পুর হাউস নামটা আমার দেয়া।
– সেই সুবাদে আছেন?
– না, তাদের অনেকগুলো বাসা আছে। একটিতে আমি ভাড়া থাকি।
– বাসায় কে কে আছেন?
– আমি আর আমার বউ। ছোটভাই ময়েজ। আম্মা-আব্বা মাঝে মাঝে আসেন।
– কি করেন?
– দেখছেন না কি করছি? আম্বরখানায় চা-পাতার ব্যবসা করি।
– চা-পাতার ব্যবসা!
– কেন, এটা কি দোষের? আমি কি চুরি করছি?
– না, চুরি নয়। তবে ব্যবসা করলে বড় কিছু করবেন। নতুবা বড় কোন চাকরি করবেন। সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকায় থাকবেন। সিলেটে আপনাকে মানায় না। ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রিয় নেতা আম্বরখানায় চা-পাতার ব্যবসা করবেন, এটা মেনে নেয়া যায় না।
– আপনি না মানলেও আমি মেনে নিয়েছি।
এ কথোপকথন কাল্পনিক নয়, বাস্তব। একবার নয়, বার বার এ সকল কথার জবাব দিতে হয়েছে। আমার বড়াপা একদিন বললেন,
– তোমার ভাগিনা কি বলে জানো?
– কি বলে?
সে বলে, ‘বড়মামা এতো লেখাপড়া করে চায়ের পাতার ব্যবসা করেন এটা বলতে লজ্জা লাগে।’
বন্ধুরা যা-ই বলুক এবং ভাগিনারা যা-ই ভাবুক, এ ভাবেই সিলেটে আমার নতুন জীবন শুরু হয়।
ঢাকার অনেক বন্ধুর কাছেও প্রশ্ন ছিল, কেন আমি সিলেট চলে এলাম? কেন ঢাকায় থাকলাম না? কিন্তু আমার কাছে এটা কোন প্রশ্নই ছিল না। সে সময় আমার কাছে বড় প্রশ্ন ছিল, কেন ঢাকায় এলাম? বাইরে ছিলাম, অনেক ভালো ছিলাম। অনেক স্বপ্ন ছিল, অনেক সুধারণা ছিল, অনেক আশা ছিল। ঢাকায় গিয়ে দীর্ঘদিন স্বযত্নে লালিত স্বপ্নসৌধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
আসলে আমার ঢাকায় আসার কথা ছিল না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। চট্টগ্রাম শহরের দায়িত্বে ছিলাম। এমএ পরীক্ষার শেষ দিন ইউনিভার্সিটি এপ্রোচে এসে ভার্সিটিকে সালাম জানিয়ে বলেছিলাম, বিদায় বিশ্ববিদ্যালয়, বিদায়! পাশ করলেও বিদায়, ফেল করলেও বিদায়। আর ছাত্র হিসেবে তোমার অঙ্গনে পা দেবো না। পাশ করলে সিলেটের কোন কলেজে মাস্টারি জোগাড় করে লেখালেখির জগতে চলে যাব। এমএ পাশ করতে না পারলে দেখবো সিলেটে কোন পত্রিকায় সুযোগ পাওয়া যায় কি না। বিয়ে করবো, মা-বাবার সাথে থাকবো, লেখালেখি করবো। কিন্তু এম এ পরীক্ষার ফল বের হবার আগেই সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেলো।
No comments:
Post a Comment