Sunday 20 September 2015

বিরাশি সালের কথকতা-২

কার্যকরী পরিষদের বৈঠকে ঢাকায় গেলাম। কেন্দ্রিয় সভাপতি বললেন, ‘ঢাকা শহরে যোগ্য লোক নেই। সভাপতি বিদায় নিয়েছেন। সেখানে এখন যারা আছেন, তাদের উপর ভরসা করা যায় না।’ আমি কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বললাম, ‘তাদের মধ্যে যে কেউ ঢাকা শহরকে যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করতে পারবেন। নতুবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অমুক এবং অমুককে নিয়ে আসুন।’ তিনি আমতা আমতা করলেন। বুঝলাম আমি যাদের নাম বলেছি ওরা তাঁর পছন্দের লোক নয়। এ ধরণের সাবজক্টিভ মনোভাব আমার একদম ভালো লাগে না। অনেকক্ষণ আলাপের পরও কোন ফায়সালা হলো না। বিরতি দেয়া হলো।
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সভাপতি পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘ (ছবি: গুগুল থেকে নেয়া)
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সভাপতি পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘ (ছবি: গুগুল থেকে নেয়া)
বিরতির সময় আলী আহসান মুজাহিদ এসে বললেন, আপনার সাথে একান্তে কিছু কথা আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি কথা?’ তিনি বললেন, ‘আপনাকে ঢাকা শহরে মাত্র ছয়টা মাস সময় দিতে হবে। তারপর আপনার ছুটি। আপনাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি অন্য কাউকে ঢাকা শহরে দিয়ে স্বস্তি পাবেন না। আপনি দীর্ঘ দিন সংগঠনের জন্যে কাজ করেছেন, আরো ছয়টা মাস ছাত্রশিবিরে থাকুন।’
আমি বললাম, ‘এটা সম্ভব নয়। আমাকে ছাত্রজীবন শেষ করতে হবে। চট্টগ্রাম শহরের বোঝা আমার ঘাড়ে দেয়া হয়েছিল একটা বিপজ্জনক ক্রান্তি লগ্নে। সেটা যতটুকু পারি বহন করেছি। চট্টগ্রাম শহর এখন নিজে নিজে চলতে পারবে। চট্টলায় যোগ্য লোকের অভাব ছিল না। শুধু ছিল আত্মবিশ্বাসের অভাব। এক বছরে তাদের নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের নির্বাচনের পর-ই আমি সিলেট চলে যাবো। আমার আব্বা-আম্মার বয়স হয়েছে। আমি তাদের বড় ছেলে। আমাকে তাদের দেখতে হবে।’
আমি আরো বললাম, ‘আমার অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়নি। আশা ছিল এম এ পরীক্ষায় সেটা পোষিয়ে নেব। কিন্তু আমাকে শান্তিতে এম এ পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়নি। আমার মনে আছে, পরীক্ষার এক মাস আগে সাংগঠনিক কাজ থেকে বিদায় নিয়ে দরজা বন্ধ করে পড়তে বসেছি। তখন চট্টগ্রাম শহরের সিনিয়র সদস্যরা একযোগে এসে বলেছেন, হয় সভাপতির পরীক্ষা হবে, নতুবা চট্টগ্রাম কলেজের নির্বাচন হবে। দুটো এক সাথে করা সম্ভব নয়। আপনি ফায়সালা দেন কোনটা হবে। টেবিলের উপর খোলা বই বন্ধ করে বলেছি, এম এ পরীক্ষা হোক বা না হোক, চট্টগ্রাম কলেজের নির্বাচন হবে। এখন থেকে আমার ছুটি বাতিল। এই ভাবে আমি এমএ পরীক্ষা দিয়েছি। এখন এমএ পরীক্ষার ফলাফল যাই হোক, আমি আর ছাত্রশিবিরে নেই।’
তিনি আমার কথার জবাবে অনেক কথা বললেন। সেখানে অনেক অযৌক্তিক এবং আবেগময় কথা ছিল। সব কথার সার কথা, ছ মাসের জন্যে আমাকে ঢাকা শহরে কাজ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত তাঁর কথা ফেলতে পারলাম না। বললাম, ‘ঠিক আছে। মনে থাকে যেন মাত্র ছয় মাস, এ থেকে একদিনও বেশি নয়।’ এ ভাবেই আমাকে চট্টগ্রাম শহর থেকে সিলেটে প্রত্যাবর্তন না করে ঢাকায় আসতে হয়।
একই বৈঠকে আরেকটি ঘটনা ঘটে। ছাত্রশিবিরের সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হবার পর কার্যকরী পরিষদ সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগ করেন। এখানে ‘পরামর্শ করে’ কথাটার ভাষাগত অর্থ হচ্ছে পরামর্শ অনুযায়ীএর ব্যবহারিক বা প্রচলিত অর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সভাপতি পরামর্শ করবেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশের পরামর্শ গ্রহণ করা তাঁর জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। এই প্রচলিত ব্যাখ্যা সেই শুরু থেকে আমরা শুনে আসছি এবং কেউ এটাকে চ্যালেঞ্জ করেনি বা এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে আলোচনা হয়নি। কিন্তু আমাদের অনেকের পর্যবেক্ষণ ছিল, যে ভাবে সাংবিধানিক এ সুযোগকে ব্যবহার করা হচ্ছে তা নানা কারণে সঠিক হচ্ছে না।
ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট
ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট
এনামুল হক মনজু কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হবার পর প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তিনি পরিষদের সদস্যদের সাথে পরামর্শ করেন এবং সাইফুল আলম মিলনকে সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগ করেন। এটা অনেকের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। ইতোপূর্বে যারা সেক্রেটারী জেনারেল হয়েছেন তারা এক, দুই বা তিন নম্বর চয়েসের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার বিচারে সাইফুল আলম মিলনের অবস্থান ছিল অনেক পেছনে। প্রশ্ন জেগেছে, কেন তাকে সেক্রেটারী জেনারেল করা হলো? কয়েক বছর থেকে দেখা যাচ্ছে, যিনি সেক্রেটারী জেনারেল নিযুক্ত হন পরবর্তীতে তিনি কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। তা হলে কি পর্দার অন্তরালে থেকে কেউ নিজেদের পছন্দমত কেন্দ্রীয় সভাপতি বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন করছে?
এর একটা জবাব আমার কাছে ছিল, যদিও সে সময় আমি কাউকে তা বলিনি। এনামুল হক মনজু কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হবার পর কাকে সেক্রেটারী জেনারেল করা যায় তা নিয়ে আমি সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথে পরামর্শ করতে চেয়েছি। তিনি প্রথমে আমাকে কিছু বলতে চাননি। অনেক চাপাচাপি করার পর বলেছেন, ‘এটা আপনাদের ব্যাপার। যাকে ইচ্ছা আপনি প্রস্তাব করতে পারেন।’
শহীদ কামারুজ্জামান, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি (ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট)
শহীদ কামারুজ্জামান, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি (ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট)
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘অমুক বা অমুক হলে কেমন হয়?’
তিনি বললেন, ‘বাইরে আছেন এমন কাউকে নিয়ে চিন্তা করুন।’
আমি বললাম, ‘কে এমন যোগ্য লোক যিনি বাইরে আছেন?’
তিনি বললেন, ‘কেন, সাইফুল আলম খান মিলন বাইরে আছেন।’
উল্লেখ্য যে তখন সাইফুল আলম খানকে সংগঠনের পক্ষ থেকে হজ্বে পাঠানো হয়েছিল।
আমি বললাম, ‘এটা হয় না। তার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ ও যোগ্য লোক আছেন।’ আমার জবাব শুনে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। তার সাথে কথা আর এগোয়নি।
পরে যখন সাইফুল আলম খান মিলনকে সেক্রেটারী জেনারেল করা হলো, আমি বুঝলাম তিনি প্রাক্তন সভাপতিদের বাছাইকৃত ব্যক্তি। এ ঘটনা পরিষদ সদস্যদের মধ্যে সংবিধানের এ ধারা পূনর্বিবেচনার চিন্তা জাগ্রত করে। মনে হয় এ কারণেই পরিষদের পরবর্তী বৈঠকে সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগের এ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আশেক আহমদ জেবাল উত্থাপন করেন। ‘মনে হয়’ এ জন্যে বলছি, আশেক আহমদ জেবালের সাথে এ নিয়ে আমার কোন আলাপ হয়নি। যদিও প্রচারণা রয়েছে, আমরা সবাই মিলে এ সংশোধনী এনেছি। তার সংশোধিত প্রস্তাব ছিল, কেন্দ্রীয় সভাপতি পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগ করবেন।
প্রস্তাবিত সংশোধনী উত্থাপিত হবার পর দেখা গেলো দুয়েকজন ছাড়া পরিষদের আর সবাই সংশোধীনর পক্ষে মতামত রাখছেন। প্রাক্তন সভাপতি হিসেবে আলী আহসান মুজাহিদ সে বৈঠকে ছিলেন। তিনি এবং কেন্দ্রীয় সভাপতি বার কয়েক প্রচলিত ধারার পক্ষে বক্তব্য রাখার পরও দেখা গেল অধিকাংশ পরিষদ সদস্য সংশোধনীর পক্ষে রয়েছেন। তখন কেন্দ্রীয় সভাপতি বৈঠক মূলতবী করে দেন। তারপর একান্তে মন্তব্য করেন, যদি এ সংশোধনী পাশ হয় তা হলে তার পক্ষে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।
বিরতির সময় আবার আলী আহসান মুজাহিদ আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘সংশোধনী পাশ হলে এনামুল হক মনজু পদত্যাগ করবেন। এটা কি ভালো হবে?’ আমি বললাম, ‘না এটা ভালো হবে না। আপনি এনামুল হক মনজুকে বোঝান, অধিকাংশ সদস্যের মতামত মেনে নেয়ার জন্যে।’ তিনি বললেন, ‘বুঝিয়ে লাভ হবে না। আপনি একটা পথ খুঁজে বের করুন।’ আমি বললাম, ‘সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী সভাপতি অধিকাংশের মত মেনে নেবেন। এটাই তো বিধান।’ তিনি বললেন, ‘তা হবে না।’ তখন আমি বললাম ‘এ অবস্থায় আমি আশেক আহমদ জেবালকে সংশোধনী প্রস্তাব প্রত্যাহার করার জন্যে অনুরোধ করে দেখতে পারি।’ তিনি বললেন, ‘তাই করুন। জেবাল এক সময় আপনার কর্মী ছিলেন, তিনি আপনার কথা শুনবেন।’
সে অনুযায়ী আমি জেবালের সাথে আলাপ করলাম। অচলাবস্থার জটিল প্রকৃতি এবং এর সাংবিধানিক পরিণতি ব্যাখ্যা করে বললাম, ‘আপাততঃ আপনার সংশোধনী প্রত্যাহার করে নেন। প্রয়োজন হলে বছরের শেষের দিকে আবার এ সংশোধনী উত্থাপন করা যাবে।’ জেবাল আমার কথা মেনে নিলেন। আমরা একটা সংকট থেকে রক্ষা পেলাম।

No comments:

Post a Comment