Sunday 20 September 2015

১৯৮২ সালের কথকতাঃ পাদটীকা

একটা ঘটনা দিয়ে আজকের লেখা শুরু করতে চাই।
বিরাট ওয়াজ মাহফিল। ওয়াজ করছেন মাওলানা আশরাফ আলী থানভী। হঠাৎ একজন তাঁর হাতে একটি চিরকুট এনে দেয়। চিরকুট হাতে নিয়ে তিনি প্রথমে নিজে পড়লেন, পরে সবাইকে পড়ে শোনালেন। চিরকুটে লেখা, ‘তুমি কাফের, তুমি মুর্খ, তুমি সাবধানে কথা বলো।’
এর পর বললেন, ‘কালেমা পড়ার পর কেউ আর কাফের থাকে না। সে মুসলমান হয়ে যায়। একজন আমাকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছেন। আমি আপনাদের সবার সামনে কালোমা পড়ছি। লা ইলাহা ইল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আগে কাফের থাকলেও এখন আমি মুসলমান।’
‘তিনি বলেছেন, আমি মুর্খ। তিনি ঠিকই বলেছেন। আমার কোন জ্ঞান নেই। আমি যা বলি তা কুরআন-হাদিস থেকে আল্লাহ এবং রাসুল (স) যা বলেছেন তা-ই বলি। এখানে আমার কোন কৃতিত্ব নেই।’
‘তিনি বলেছেন, সাবধানে কথা বলো। আমি এমনিতেই সাবধানে কথা বলি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমার সব কথা ফেরেশতারা লিখে রাখছেন। কেয়ামতের দিন সকল কথার জন্যে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আপনার নসিহতের পর আমি আরো সাবধানে কথা বলবো।’
আমি মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর এ কথাগুলো মনে রাখার চেষ্টা করি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রথম এবং তৃতীয় জবাবটি খুব প্রাসঙ্গিক। কেউ আমাকে গোমরাহ বা ইসলাম থেকে খারিজ করে দিলে তওবা করে কালেমা পড়ে নিয়ে ভাবি, আমাকে কথা বলা এবং লেখার ব্যাপারে আরো সাবধান হতে হবে।
৮২ সালের কথকতা পড়ে কেউ কেউ হয়তো কষ্ট পেয়েছেন। কারো কারো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে তা বোঝা যায়। আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাই। কাউকে কষ্ট দেয়ার জন্যে এ লেখা নয়। এ লেখা কাউকে প্রমোট করার জন্যেও নয়। কারো আত্মত্যাগ-অবদানকে ছোট করে দেখা অথবা কোন দায়িত্বশীলকে হেয় বা অবমূল্যায়ন করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
লেখা প্রকাশিত হবার পর এ ব্যাপারে অসংখ্য প্রশ্ন এসেছে। সকল প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। আমি ততটুকু-ই জানি যা আমার সামনে ঘটেছে এবং তা-ই বর্ণনা করেছি। এর বাইরে খুব একটা তথ্য আমার কাছে নেই। অসংখ্য মানুষ আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। যারা যোগাযোগ করেছেন তাদের মধ্যে বৃটেনসহ বাংলাদেশ, কানাডা, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে বসবাসকারী মানুষ রয়েছেন। অধিকাংশ মানুষ লেখাকে স্বাগতঃ জানিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, শেষের দিকে এসে মনে হয়েছে আমি তাড়াহুড়া করছি। আরো লেখার প্রয়োজন ছিল। আমি স্বীকার করি, হয়তো আরো অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ ছিল। সময়ের সীমাবদ্ধতা, তথ্য-উপাত্তের অনুপস্থিতি এবং উৎসাহের অভাবের কারণে এমনটি হয়েছে।
কিছু পাঠক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ অশোভন ভাষায় আমার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন। উল্লেখিত তথ্য সম্পর্কে কোন পাল্টা তথ্য উপস্থাপন না করে নানা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে বালখিল্যতা দেখিয়েছেন। কেউ বলেছেন, এ লেখার মাধ্যমে আমি অপরাধ করেছি। সে জন্যে তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসতে হবে। নতুবা আমাকে এ জন্যে দুনিয়া এবং আখেরাতে ক্ষতির সম্মূখীন হতে হবে। আরো বহু ধরণের নসিহত আমার প্রতি বর্ষিত হয়েছে। তওবা করার ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই। প্রত্যহ কমপক্ষে দু বার এবং সুযোগ পেলে কয়েকবার আমি তওবা করি। পাঠকের দেয়া নসিহত অনুসরন করে আবার তওবা করছি। হে আল্লাহ! জেনে না জেনে ছোট-বড় যত অপরাধ করেছি, তুমি তা মাফ করে দাও এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার পথে অটল থাকার তওফিক দাও।
যারা পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাদের সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। পাঠকদের প্রশ্ন ও মন্তব্য থেকে আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পেরেছি, নতুন বিষয় অনুধাবন করেছি। আমার লেখায় যাদের নাম এসেছে তাদের কারো প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই। ঘটনা বর্ণনার প্রয়োজনে তাদের নাম এসেছে মাত্র। যারা আমার প্রতি অশোভন আচরণ করছেন তারা হয়তো মহৎ উদ্দেশ্যে সেটা করছেন। আমি যদি তাদের মতো চিন্তা করতাম এবং তাদের অবস্থানে থাকতাম তা হলে আমিও হয়তো একই ধরণের আচরণ করতাম। তবে উদ্দেশ্য মহৎ হলেই কোন কাজ সঠিক হয়ে যায় না। ইসলামের দৃষ্টিতে কাজের পদ্ধতিও সঠিক হতে হবে। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাদের অপরাধ সমূহ ক্ষমা করেন এবং সৎকর্মসমূহ কবুল করেন।
আমি যে বিষয় নিয়ে লিখেছি সে বিষয় সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম সরাসরি অবহিত নয়। ঘটনা ঘটেছে ৩৩ বছর আগে। সে সময় যারা জড়িত ছিলেন তারা বলতে পারেন, আমি ঠিক বলছি না ভুল বলছি। আমি মানুষ, ফেরেশতা নয়। আমার ভুল হতে পারে, আমার ভুল হয়। জীবনে বহু ভুল করেছি। আমার আশা ছিল, আমার লেখায় ভুল তথ্য থাকলে প্রত্যক্ষদর্শীর রেফারেন্স বা বিকল্প তথ্য দিয়ে কেউ তা খন্ডন করবেন। সে সময়ের কার্যকরী পরিষদের অনেক সদস্য মাঠে-ময়দানে আছেন। তাদের সাথে আলোচনা করে প্রদত্ত বিবরণ যাচাইয়ের সুযোগ আছে। কিন্তু কেউ তা করতে এগিয়ে এসেছেন বলে আমার চোখে পড়েনি। তথ্য খন্ডন না করে আজে-বাজে মন্তব্য করলে ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যায় না। তা ছাড়া কেউ বিজয়ী অথবা শক্তিশালী হবার অর্থ এ নয় যে প্রতিপক্ষের যুক্তি বা তথ্য ভুল ছিল। যুগে যুগে, দেশে দেশে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস অতীতে অনেক হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা কখনো ফলপ্রসু হয় না। একদিন সত্য আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। আমাদের জানা ইতিহাস তাই বলে।
আমার লেখা পাঠ করে যারা অশোভন ভাষা ব্যবহার করেছেন তাদের নিকট থেকে আমার জন্যে শিক্ষনীয় দিক রয়েছে। আমি যদি আরো মধুর ভাষায় লিখতে পারতাম, আরো যৌক্তিক ভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে পারতাম তা হলে হয়তো তারা অশোভন ভাষা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতেন। তাদের ভাষা থেকে আরেকটা জিনিস আমি বুঝেছি। গত ১২ বছর আমি বাংলাদেশে যাইনি। অন্যান্য দলের অনেকের কাছ থেকে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আমার কাছে আসে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে পড়াশোনার পরিধি এবং আচরণ। আমি ভাবতাম, ওরা বিরোধিতার খাতিরে তা বলছে। এখন তাদের ভাষা এবং বক্তব্য দেখে বুঝতে পারছি, উত্থাপিত অভিযোগের সবটুকু বানানো নয়। তাদের পড়াশোনা খুব সীমিত এবং কারো কারো আচরণ থেকে পরিস্কার বোঝা গেছে, তারা ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না।
‘মানুষের সাথে সুন্দর করে কথা বলো’ – এটা কুরআনের নির্দেশ। নবী মুসা (আ) এবং তাঁর ভাই হারুন (আ) কে আল্লাহ ফেরাউনের মতো খোদাদ্রোহীর কাছে গিয়ে দাওয়াত দিতে নির্দেশ দেন। সেখানে বলে দেন, ‘তার সাথে তোমরা নম্র ভাষায় কথা বলবে।’ সুতরাং কোথাও কেউ দোষ করলে নরম ভাষায় বলা ইসলামী আচরণের দাবি। মহানবী (স) বলেছেন, ‘মানুষের জন্যে সহজ করো, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, মানুষের মধ্যে বিরক্তি সৃষ্টি করো না।’
আমি আগেও বলেছি, এটা আমার আত্মকথা। এর আগেও আত্মকথা লিখেছি। সেটা ছিল কিশোর বয়সের কথা। ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে। আমার ওয়েব-সাইটে আছে। আলোচ্য লেখার নাম ছিল ‘৮২ সালের অকথিত কথকতা’। এক বন্ধু বললেন, শিবিরের নামটা যোগ হলে পাঠক বুঝবে আপনি কোন প্রসঙ্গে কথা বলছেন। ’৮২ সালের সংকট নিয়ে লেখার জন্যে অতীতে দেশ-বিদেশের অনেক বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীর পক্ষ থেকে আমার কাছে বার বার অনুরোধ এসেছে। আমি এতদিন তাদের কথায় কান দেইনি। লেখাটি অনেক আগে তৈরি হলেও নানা দিক বিবেচনা করে এতদিন প্রকাশ করিনি।
লেখা পাঠ করে অনেকে এর পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন। র (RAW) এবং মোসাদকে টেনে আনছেন। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বাংলাদেশী মানুষের প্রিয় প্রসঙ্গ। ইসলামী ঘরাণার লোক এর ব্যতিক্রম নয়। এর আগে আমরা মাওলানা আব্দুর রহীম সম্পর্কে শুনেছি, তিনি সিআইএ’র দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধির সাথে বৈঠক করেছেন। ভিন্নমতের লোকদের ব্যাপারে ‘র’ কানেকশনের কথা ইতোপূর্বেও প্রচার করা হয়েছে। আহমদ আব্দুল কাদের সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। আমার সম্পর্কে এতোদিন কিছু শুনিনি, এ লেখা প্রকাশের পর বলা শুরু হয়েছে।
আমি জানি আমি কেন লিখেছি এবং যা লিখেছি জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী সত্য লিখেছি। আমরা দেখেছি, ৮২ সালে নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিল একই ধরণের সংকট পরবর্তীতেও হয়েছে। তাই বিষয়টা নিয়ে পর্যালোচনা হওয়া সময়ের দাবি বলে আমি মনে করি। এ প্রেক্ষিতেই এ সকল বিষয় এসেছে। কেউ চাইলে যারা সে সময় জড়িত ছিলেন তাদের নিকট থেকে এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখতে পারেন। আমার বিবরণ বিশ্বাস করা বা না করা পাঠকদের বিষয়। কাউকে আমার কথা বিশ্বাস করার জন্যে বাধ্য করার অধিকার বা ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমার লেখার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যারা বাজে এবং অশালীন মন্তব্য করছেন সে দায়িত্ব তাদের। আমি বিশ্বাস করি, আমার ভাষা আমার পরিচয় বহন করে, তাদের ভাষা তাদের।
কেন আমি ৮২’র সংকট নিয়ে লেখার জন্যে বর্তমান সময় বাছাই করেছি, এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের উল্লেখ করে কোথাও কোথাও ‘ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইলিং’ চলছে। রাজনৈতিক সংকটের কথা বলে যে কোন ইসলাম-পছন্দ ব্যক্তিকে প্রভাবিত করা সম্ভব। এটা ঠিক, মানুষ যখন হত্যা, নির্যাতন, গুম এবং জুডিসিয়াল কিলিং এর মুখোমুখি তখন এ সব পুরাতন কথা শুনতে কারো ভালো লাগার কথা নয়। যারা আমার কাছাকাছি আছেন এবং যাদের সাথে আমার অন-লাইন যোগাযোগ আছে তারা ভালো করেই জানেন, চলমান নির্যাতন ও জুডিসিয়াল কিলিং এর কারণে আমার অশ্রুপাত ও রক্তক্ষরণ কারো থেকে কম নয়। কিন্তু এ সংকটের কারণ কী তা আমাদের অন্বেষণ করা দরকার। ধামাচাপা বা গলাবাজি নয়, সত্যিকার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করছি, সংকট সৃষ্টির কারণ এবং তা থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া অন্বেষণ শুরু হয়েছে। আমার এ আলোচনা সংকট উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
৭১ নিয়ে আমি আজ হঠাৎ করে আলোচনা শুরু করিনি। ৮২’র আগে এবং পরে অনেক আলোচনা করেছি। সিলেট থেকে প্রকাশিত এবং মুকতাবিস-উন-নূর সম্পাদিত সাপ্তাহিক সিলেট কন্ঠে ’৮২ সালের শেষের দিকে একবার এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য লিড-নিউজ হিসেবে ছাপা হয়েছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সুরমায় ২০০৩ সালে এ বিষয়ে আমার লেখা ছাপা হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে অনেক অন-লাইন আলোচনাও আছে। এ প্রসঙ্গে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ড. আব্দুস সালাম আজাদী তাঁর ফেইস-বুক স্ট্যাটাসে খুব সুন্দর একটা মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘
মুহতারাম ফরিদ আহমাদ রেজা ভাইকে আমাকে একসময় ঘৃণা করতে শেখানো হয়েছিল। কারণ তারা শিবিরকে ভেঙ্গেছেন। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠতায় আসার পর মনে হয়েছে, যারা তাকে শিবির ভাঙ্গার অপবাদ দিয়েছিলো, যারা বলতো তিনি আর ইসলামে নেই, তারা অনেক ভুল কথা বলেছেন। ইদানিং তিনি ১৯৮২ এর শিবিরের ক্রান্তি কাল নিয়ে লিখছেন, আমার মত অনেকে কৌতুহলি হলেও বেশ কিছু তরুণ অতরুণ তাকে নিয়ে বিষোদ্গার করছেন। আমি বলি এই সব কথা আসা ভালো। ইসলামি আন্দোলনে এখন নতুন মোড়ের সময়, এই সময়ে আমাদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে পা না বাড়াতে পারলে আমাদের গর্তগুলোতে আবারো আমরাই পড়তে পারি। আমাদের মত মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারিরা যদি আমাদের ই একজনের কথা সইতে না পারি……………!!!’
আমার লেখার ব্যাপারে অনেক অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এসেছে। এটা লেখার উদ্দেশ্য, আমার ব্যক্তিগত কাজ-কর্ম, ভাষার ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনার সাথে সাথে অনেক আপত্তিকর মন্তব্য এসেছে। এ সব প্রশ্ন বা মন্তব্যের জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
৭১ এবং যুবশিবির নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং মূল্যবান মন্তব্য এসেছে। কেউ কেউ কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। আরেকটা মৌলিক প্রশ্ন, ৮২ সালে সংকট সৃষ্টির কারণ কী? এ সকল প্রশ্নের কোনটাই এমন নয় যে এক কথায় বা সংক্ষেপে জবাব দেয়া যায়। প্রত্যেকটির ব্যাপারে স্বতন্ত্র আলোচনার প্রয়োজন। ৭১ প্রসঙ্গে শিবিরের কার্যকরী পরিষদের বৈঠকে এ নিয়ে কোন পর্যালোচনা হয়েছিল বলে আমি জানি না। আমার উপস্থিতিতে কোন মতবিনিময়ও হয়নি। ময়দানে কাজ করতে গিয়ে আমরা বুঝেছি, ৭১ ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটা সিদ্ধান্ত নেয়া সময়ের অনিবার্য দাবি। শুরু থেকেই ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বলিষ্ঠভাবে কথা বলছি। আমরা বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন করি। কিন্তু ৭১ সালে জামাতের ভূমিকা নিয়ে ময়দানে আমরা কিছু বলতে পারি না। জামাতের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে লিখিত বা অলিখিত কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই।
অপরদিকে স্বাধীনতার পর থেকে মাঠে-ময়দানে এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে একতরফা ভাবে ৭১ ইস্যু নিয়ে জামাতের বিরুদ্ধে প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে। এর প্রেক্ষিতেই বিষয়টা আলোচনায় এসেছে। জামাত রাজনৈতিক ভাবে অখন্ড পাকিস্তানের সমর্থক ছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল, এটা কোন গোপন বিষয় ছিল না। কিন্তু কেন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল তা কখনো পরিস্কার করে বলা হয়নি। আমাদের দাবি ছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিষয়টা নিয়ে পর্যালোচনা করা দরকার। পর্যালোচনা করে যদি জামাত মনে করে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল তা হলে এর কারণসহ তা জনগণের সামনে পেশ করতে হবে। যদি দেখা যায়, সে সিদ্ধান্ত ভুল ছিল তা হলে তাও জনগণকে অবহিত করতে হবে। যে কোন বিচারে এ দাবির যৌক্তিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।
৭১-এর ব্যাপারে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গঠন, দায়িত্বশীল নিয়োগ, প্রশ্নপত্র তৈরি ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক কথা ময়দানে চালু আছে। কিন্তু এ মুহূর্তে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্য দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ২০০৬ সালে পলিটিক্স এন্ড ডেভেলাপমেন্ট অব দ্যা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ (BD-ISBN:984-8360-17-4) নামক একটি বই বাজারে এসেছে। বইয়ের লেখক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ভূইয়াঁ মনোয়ার কবির। এর প্রকাশক এ এইচ ডেভেলাপমেন্ট পাব্লিশিং হাউস, ঢাকা। এ বইয়ে এ ব্যাপারে রেফারেন্স সহ আলোচনা করা হয়েছে। আগ্রহীরা বইটি পড়ে দেখতে পারেন। আগ্রহী কেউ প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে এ ব্যাপারে গবেষণা করতে পারেন।
২০০৩ সালের জুলাই মাসে লন্ডনের সুরমা পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখায় বলেছিলাম, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে বাংলাদেশের অধুনিক প্রজন্মের সাথে ইসলামী আন্দোলনের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে এরও একটা সমাধান হওয়া দরকার। শুধু বিজয় স্মৃতিস্তম্ভে ফুলদান করে সে দূরত্ব দূর করা যাবেনামরহুম খুররম মুরাদ তরজমানুল কুরআনে (জানুয়ারী, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ১৫-১৬) প্রকাশিত তার জীবনের সর্বশেষ লেখায় এ প্রসঙ্গ খুব সুন্দরভাবে অবতারণা করেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, জনগণের সাথে এবং জনগণের জন্য যারা কাজ করেন তাদের উচিত নিজেদের ভুল সিদ্ধান্ত বা ভুল কাজ গোপন না করে অথবা এর ভিন্ন ধরণের ব্যাখ্যা না দিয়ে প্রকাশ্যে জনগণের সামনে ভুলের স্বীকৃতি দেয়া। এর ফলে জনগণের সামনে তাদের সম্মান হ্রাস না পেয়ে আরো বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, খুররম মুরাদ বহু বছর ঢাকায় বাস করেছেন এবং ৭০-৭১ সালেও ঢাকায় ছিলেন। তখন তিনি ঢাকা শহর জামাতে ইসলামীর আমীর ছিলেন।
আমার মতে, পাক-বাহিনীর সাথে সহযোগিতার বিষয়টি ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন ফোরামে পর্যালোচনা হওয়া সময়ের দাবি এবং সে পর্যালোচনা জনসমক্ষে আসা দরকার। মহানবীর (সঃ) সমসাময়িক কোনো কোনো কাজের পর্যালোচনা কুরআনে খোলাখুলিভাবে এসেছে এবং তা কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। এতে মহানবী (স:) বা সাহাবাদের মর্যাদা কিছুমাত্র ক্ষুন্ন হয়নি।’
যুব শিবির গঠন, সময়কাল, এর যৌক্তিকতা, পরিধি, কর্মকৌশল, কেন যুবশিবির খেলাফত আন্দোলনের সাথে একীভূত হলো ইত্যাদি ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে। আমি যুব শিবিরের কেউ-কেটা ছিলাম না। সংগঠনের দৈনন্দিন কাজের সাথেও জড়িত ছিলাম না। যারা এটা গঠন করেছেন তারাই এ সকল প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। যুব শিবির প্রতিষ্ঠার যৌক্তিতা ব্যাখ্যা করা বা যুবশিবিরকে প্রমোট করা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি শুধুমাত্র নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ঘটনাবলীর একটা বিবরণ উপস্থাপন করেছি।
৮২ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যুব শিবিরের আলোচনা আসতে বাধ্য। যুবশিবির নিয়ে যে সকল প্রশ্ন এসেছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাকে আরো পড়াশোনা করতে হবে এবং গঠন প্রক্রিয়ায় যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তাদের সাথে আলোচনা করতে হবে। কিন্তু তা করার সময় বা আগ্রহ কোনটাই আমার নেই। যে কেউ তা করতে এগিয়ে আসতে পারেন। আমি যেটা জানি তা হলো, শিবিরের প্রাক্তন নেতৃবৃন্দ একটা যুব-সংগঠন গঠনের চিন্তা অনেক আগে থেকেই করছিলেন। পাঠকদের মনে থাকবে, শিবিরের প্রাক্তন সভাপতি মাওলানা আবু তাহেরের সাথে আলোচনার সময় আমি সে কথা তাঁকে বলেছি। আমার মতে, ৮২’ এর সংকট ভিন্ন কাঠামো দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করেছে মাত্র।
আমার মনে হয় এখানে আরেকটি কথা পরিস্কার করা দরকার। আমার বিভিন্ন লেখায় বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ থাকলেও বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
লন্ডন, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শিবিরের ক্রান্তিকালঃ১৯৮২ সালের কথকতা-৭

গোটা দেশে যখন যুবশিবিরকে কেন্দ্র করে ছাত্রশিবির এবং জামাতে ইসলামীর মধ্যে বাদানুবাদ, বিতর্ক এবং হুমকি-ধমকি চলছে তখন হঠাৎ করে অধ্যাপক গোলাম আযমের সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। তিনি সিলেট এসেছেন এটা আমার জানা ছিল না। এক শবেবরাতে বন্ধুবর আব্দুল হামিদ মানিককে নিয়ে রিক্সায় চড়ে শহর দেখতে বেরিয়েছি। নয়া সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ মনে হলো খায়রুন্নেসা ভাবীর হাতে তৈরি শবেবরাতের মিষ্টি খেয়ে যাই। তাদের বাসার সামনে রিক্সা থামিয়ে কলিং বেল টিপলাম। দরজা খুললেন অধ্যাপক ফজলুর রহমান। আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন, ‘আপনি এসেছেন, খুব ভালো কথা। আসুন, বসুন। প্রফেসার গোলাম আজম তো এখন মিটিংয়ে। দেখি কালকে আপনার জন্যে সময় পাওয়া যায় কি না।’ এ কথা বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি ভেতরে চলে গেলেন। বাধ্য হয়ে বসতে হলো। ফিরে এসে বললেন, ‘আপনি এসেছেন, প্রফেসার সাহেব খুশি হয়েছেন। কালকে ১০টায় তিনি আপনাকে সময় দিয়েছেন।’ অযাচিত সাক্ষাতকারের দিনক্ষণ নিয়ে তার বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম, শবে বরাতের মিস্টি খাওয়া আর হলো না।
পরদিন যথাসময়ে সেখানে হাজির হলাম। প্রফেসার সাহেব খুব আন্তরিকতার সাথে আমার সাথে কোলাকুলি করলেন। খোঁজ খবর নিলেন, কি করছি, কি ভাবে দিনকাল চলছে। খুচরা ব্যক্তিগত খবরা-খবর। এর পর কিছু সিরিয়াস বিষয় অবতারণা করলেন। বললেন, ‘এই যে তোমরা ইসলামী আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, এটা কি ঠিক হলো?’
আমি বললাম, ‘বিচ্ছিন্ন কোথায়? আগে আমাদের শুরু ছিল রাসুলে করীম (স) থেকে, মধ্যখানে লম্ফ দিয়ে সোজা মওলানা মওদুদী। এখন রাসুলে করীম (স) থেকে শুরু করে সাহাবায়ে কেরাম, সলফে সালেহীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন সবার সাথে আছি। গত ১৪ শ বছর যাবত যারা দ্বীনের কাজ করেছেন এবং এখনো করছেন তাদের সকলের সাথে এখন আমরা সম্পৃক্ত। এটা কি বৃহত্তর সংযুক্তি বা ঐক্য নয়।’
আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে তিনি শুধু মুচকি হাসি দিলেন। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়ে বললেন, ‘তোমরা এ সব কি শুরু করছো? আমি সিলেটের সোলায়মান হলে বক্তৃতা দেব শোনে হলের সর্বত্র যুবশিবির জিন্দাবাদ লিখে রেখেছো, এর অর্থ কি?’
আমি বললাম, ‘আপনি যে সিলেট আসবেন এ খবর যুব শিবিরের কে কতটুকু জানে আমি জানি না। আমি যুব শিবিরের কোন দায়িত্বশীল নই। আমিও আপনার প্রোগ্রাম সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। গতরাত হঠাৎ করে এ বাসায় এসে জানলাম আপনি সিলেট এসেছেন। তা ছাড়া আমি দেখেছি, যুব শিবির শহরের সর্বত্র দেয়াল লিখন করেছে। আমার মনে হয় এর অংশ হিসেবেই তারা সোলায়মান হলের দেয়ালেও লিখেছে। আপনার আগমনের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না।’
আমার জবাব শুনে তিনি এ ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন উত্থাপন করেননি। আরো কিছু প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক আলাপ হলো। এক সময় আমি বললাম, ‘জামাতের তো টাকা আছে। চাইলে তারা কিছু সিনেমা-নাটক তৈরি করতে পারে।’
তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘সিনেমা-নাটক কি ভাবে করবে? মহিলাদের অংশ গ্রহণ ছাড়া বানিজ্যিক ভাবে সিনেমা নাটক সফল হবে না।’
আমি বললাম, ‘মহিলারা অংশ নিবে।’
– ‘এটা কি বলো? মহিলারা কি নিকাব পরে সিনেমায় অংশ নিবে?’
– ‘নিকাব পরবে কেন? মুখ খোলা রাখবে। মুখ খোলা রাখাতে কোন দোষ নেই।’
– ‘মুখ কি ভাবে খোলা রাখবে? এটা তো বৈধ নয়। তুমি কি পর্দা ও ইসলাম বই পড়োনি?’
– ‘পড়েছি। ভালো করেই পড়েছি। সেখানে মাওলানা মুখ ঢেকে রাখার পক্ষে অনেক যুক্তি-তর্কের অবতারণা করেছেন। কিন্তু মুখ ঢাকা রাখার ব্যাপারে কুরআন-হাদীস থেকে কোন রেফারেন্স দেননি। তা ছাড়া মুখ ঢাকা ফরজ হলে কুরআন বা হাদীসে তা স্পষ্ট করে তা বলে দেয়া হতো। কোন ফরজ কাজকে আল্লাহ বা তাঁর রাসুল (স) অস্পষ্ট রাখবেন তা ভাবা যায় না। ’
আমি এ কথা বলার পর এ ব্যাপারে তিনি আর কোন কথা বলেননি। আমি বললাম, ‘জামাত নাটক-সিনেমা নিজ নামে না করে বিত্তশালী লোকদের এ দিকে উৎসাহিত করতে পারে। অর্থের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীদের এ কাজে পাওয়া যাবে। তারা যদি স্কার্ফ মাথায় দিয়ে এবং শালীন পোশাক করে নাটক-সিনেমায় অভিনয় করে তা হলে বাংলাদেশী তরুণীরা সহজেই এ দিকে আকৃষ্ট হবে। এমনটি করা গেলে শালীন পোশাক এবং স্কার্ফ বাঙালি ফ্যাশনে পরিণত হবে।’
তাঁর চেহারা দেখে মনে হলো আমার এ কথা তার কিছুটা পছন্দ হয়েছে। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, ‘ঠিক কাছে, তোমার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবো।’
একদিন ঢাকা থেকে ইসলামী ব্যাংকের তদানীন্তন চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক লস্কর খবর পাঠালেন। তিনি ইসলামী ব্যাংকের সিলেট শাখার জন্যে স্থান নির্ধারণের উদ্দেশ্যে সিলেট আসছেন, আমার সহযোগিতা দরকার। সময় মত তিনি আসলেন। তাঁর কাছে দুটি জায়গার প্রস্তাব ছিল। তাঁর সাথে গিয়ে জায়গাগুলো দেখলাম। আরো দুয়েকটি প্রস্তাব এলো। সেগুলোও দেখলাম। দুপুরে আমার বাসায় ডাল-ভাত খেলেন। তখন বললেন, ‘এতক্ষণ যে কাজ করলাম এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ তোমার সাথে আছে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী সেটা?’ বললেন, ‘তোমাকে জামাতের সদস্য হতে হবে।’ জানতে চাইলাম, ‘আপনি কি জামাতের সদস্য হয়েছেন?’ জানালেন, তিনি জামাতের সদস্য হননি। বললাম, ‘যে সংগঠনের সদস্য আপনি হননি, সে সংগঠনের সদস্য হবার জন্যে আমাকে চাপ দেয়ার মানে কি?’ বললেন, ‘আমার কথা ভিন্ন। কিন্তু তোমাকে হতে হবে।’ বললাম, মাফ করবেন। এটা সম্ভব নয়।’ এর পর তিনি এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা বাড়াননি।
ঢাকা থেকে ছাত্রশিবির, যুবশিবির এবং জামাতের নেতৃবৃন্দ সিলেট এলে তাদের কেউ কেউ দয়া করে আমাকে দেখতে এসেছেন আমার চা-পাতার দোকানে। যুবশিবিরের আহমদ আব্দুল কাদের এবং মুজাহিদুল ইসলাম, ছাত্রশিবিরের সাইফুল আলম খান মিলন এবং ডাঃ আমিনুল ইসলাম মুকুল, জামাতে ইসলামীর মুহাম্মদ কামরুজ্জামান চা-পাতার দোকনে এসেছেন। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা আবু তাহের এবং ব্যরিস্টার আব্দুর রাজ্জাক চা-পাতার দোকানে আসেননি, বাসায় এসেছেন। আমার মনে হয় অন্য সকলের আগমন ছিল সৌজন্য মূলক এবং মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের আগমন ছিল নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখে। তাঁর আগমনের একটা পটভূমি রয়েছে।
আগেই বলেছি, ছাত্রশিবির এক সময় ঘোষণা করে, যারা শিবিরের সাথী হবে তাদের জামাতে ইসলামীকে একমাত্র ইসলামী আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হবে। এর ফলে ছাত্রশিবিরের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ছাত্রশিবিরের এ সিদ্ধান্ত সারা দেশে শিবিরের মধ্যে ভাঙন-ক্রিয়াকে ধারালো ও তরান্বিত করে। আমি ভাবছিলাম, শিবিরের মধ্যে প্রতিক্রিয়া ও পোলারাইজেশন লক্ষ্য করে জামাত এ ব্যাপারে একটা সমঝোতার পথে এগিয়ে আসবে। সিলেট জেলা জামাতের আমীর অধ্যাপক ফজলুর রহমানকে প্রায়ই একটা কথা বলতে শুনেছি। তিনি বলতেন, ‘যুব শিবিরের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই। আমি যুবশিবিরকে জামাতেরই যুবফ্রন্ট হিসেবে দেখি।’ আমার জানামতে সে সময় জামাতে ইসলামীর আরো অনেকে এ মনোভাব পোষণ করতেন।
কিন্তু আমি দেখলাম, যুবশিবির, জামাত এবং ছাত্রশিবিরের মধ্যে বিরোধ, উত্তেজনা, পারস্পরিক চরিত্র হনন দিনে দিনে বাড়ছে। বিরোধী পক্ষের সাথে লড়াইয়ের পরিবর্তে তারা পরস্পর লড়াই করে সময় ও শক্তি ক্ষয় করছে। এ লড়াই এবং শক্তি ক্ষয় বন্ধের জন্যে আমি আমীরে জামাতের কাছে দুটি চিঠি লেখি। আমরা জানি সময় অনেক সময় বড় বড় ক্ষত শুকিয়ে দিতে পারে। এখন যদি সকল পক্ষ যার যার মত কাজ চালিয়ে যেতে পারে তা হলে হয়তো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এক সময় সবাই মিলে একটা সমঝোতার পথ অন্বেষণ করা যেতে পারে। এ চিঠির জবাব দিতেই মুহাম্মদ কামরুজ্জামান আমার সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি এসে বললেন, ‘প্রফেসার সাহেব আপনার চিঠি পেয়েছেন। আপনার উদ্বেগ এবং পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ দিয়েছেন। সাথে সাথে একটা বার্তা আপনাকে পৌঁছে দিতে বলেছেন।’
আমি খুব ঔৎসক্যের সাথে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সে বার্তাটি কী?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘অতীতে যা হবার হয়েছে তা ভুলে গিয়ে আপনাকে জামাতে ইসলামীতে যোগ দিতে বলেছেন। সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের কারণে জামাতে ইসলামীর সদস্য হতে আপনার কোন অসুবিধা হবে না।’ তাঁর জবাব শোনে আমি কয়েক মিনিট চুপ থাকলাম। তারপর বললাম, ‘প্রফেসার সাহেবকে আমার সালাম এবং ধন্যবাদ জানাবেন। আমার প্রতি তাঁর সুধারণা এবং ভালোবাসার শোকরিয়া জ্ঞাপন করছি। তবে তাঁকে বলবেন, জামাতে ইসলামীর সদস্যপদ গ্রহণের কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি বর্তমানে এ থেকে অনেক দূরত্বে অবস্থান করছি।’
কিছুদিন পর আমার অনেক পুরানো বন্ধু এবং বর্তমানে বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় অধ্যাপক আব্দুল মুসাওয়ীর আমার বাসায় এলেন। তিনি তখন সাউদি আরবে থাকেন। প্রথমে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে অনেক খোঁজ-খবর নিলেন। জামাত, শিবির এবং যুবশিবিরের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী জানতে চাইলেন। রেখে-ঢেকে কিছু কথা বললাম। অনেক রাতে তিনি বিদায় নিলেন। এর দুয়েক দিন পর সন্ধ্যার পর ফোন করলেন অধ্যাপক ফজলুর রহমান। বললেন, তিনি এখনই আমার বাসায় আসতে চান, জরুরী কথা আছে। তিনি এলেন, তাকে সাদরে বসালাম। চা-বিস্কুট খেতে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী এমন জরুরী কথা?’ বললেন, ‘এই মাত্র প্রফেসার গোলাম আযমের ফোন পেলাম। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আপনাকে এক্ষুনি যেন শাহ জালাল জামেয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দেই। তিনি আপনাকে কালকেই সেখানে যোগ দিতে বলেছেন।’
তার কথা শোনে অবাক হলাম। কি এমন ঘটনা ঘটলো যার কারণে ঢাকা থেকে এ রকম হুকুমনামা এলো। আমার জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বললেন, ‘অধ্যাপক আব্দুল মুসাওয়ীরের সাথে আপনার আলাপ হয়েছে। তিনি ঢাকায় গিয়ে প্রফেসার সাহেবের সাথে দেখা করেছেন। অধ্যাপক আব্দুল মুসাওয়ীরের কথায় প্রফেসার সাহেব এতটা প্রভাবিত হয়েছেন যে সাথে সাথে আমাকে ফোন করে এ নির্দেশ দিয়েছেন।’
আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম, ‘আমি আপনার এবং প্রফেসার সাহেবের শোকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আপনার কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ। আপনি আমাকে জামেয়াতে একটা চাকরি দেয়ার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমার পক্ষে এখন আর জামেয়াতে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি যে ভাবে আছি, অনেক ভালো আছি। এখন আমি অনেক স্বাধীন। কলেজে যাই, ক্লাস করি। তারপর সিলেট চলে আসি। বাকি সময় আমার নিজস্ব। জামেয়ায় গেলে গোলামী করতে হবে। আমি গোলামী করতে পারবো না।’
উল্লেখ্য, সে সময় আমি বন্ধুবর অধ্যাপক আব্দুল হান্নানের চাপে এবং তাজপুর কলেজের অধ্যক্ষ মুহিব উদ্দীনের অনুরোধে চুনারুঘাট কলেজ ছেড়ে তাজপুর কলেজে চলে এসেছি। তাজপুর কলেজ সিলেট শহরের খুব কাছে, কলেজের ক্লাস শেষে সিলেট শহরে সহজেই ফিরে আসা যেত। ততদিনে চা-পাতার ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি। ব্যবসায় কোন লাভ করতে পারিনি। বন্ধুবর আব্দুল কাইয়ূম অত্যন্ত বন্ধু-বৎসল এবং দানশীল। তিনি দয়াকরে ব্যবসায় দেয়া তার পুঁজি আর ফেরত নেননি। ততদিনে আমার স্ত্রী সিলেট শহরের কিশোরী মোহন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি জোগাড় করে নিয়েছেন। অবশ্য দু জনের চাকরির আয় সংসার পরিচালনার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। আমার ঘনিষ্ট বন্ধু আব্দুল হামিদ মানিক, রাগিব হোসেন চৌধুরী, হারুনুজ্জামান চৌধুরী প্রমুখের সহযোগিতায় সিলেট রেডিওতে কথিকা পড়ে এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে কিছুটা বাড়তি আয়ের সুযোগ হয়েছে।
ইসলামী ফাউন্ডেশনের সৈয়দ মোস্তফা কামাল ডাকতেন বক্তৃতা দিতে। মাঝে মধ্যে যুবশিবিরের লোকেরাও ডাকতো আমাকে। ইসলাম বা সাহিত্য বিষয়ক আলোচনার জন্যে অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকেও দাওয়াত পেতাম। সিলেট প্রেসক্লাব, মুসলিম সাহিত্য সংসদ, বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন ইত্যাদি নিয়ে এ সময় খুব ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছি। শাহ জালাল জামেয়ায় গিয়ে জামাতে ইসলামীর গোলামীর চেয়ে এ সব নিয়েই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। এর কয়েক বছর পর আমি সিলেট থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে লন্ডনে চলে আসি। গত ৯১ সাল থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে লন্ডনে বাস করছি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এতোদিন পর এ সকল পুরানো কথা আলোচনার কী কোন প্রয়োজন আছে? আমার মতে অন্য কোন প্রয়োজন না থাকলেও ইতিহাসের একটা দায় আছে। সে দায় মুক্তির খাতিরেই এর অবতারনা।
আত্মকথনের একটা পর্যায় শেষ হলো। অনেক প্রশ্ন এসেছে। সকল প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু সেগুলোর হয়তো গুরুত্ব আছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেও জানি না।

শিবিরের ক্রান্তিকালঃ১৯৮২ সালের কথকতা-৬

শেষ পর্যন্ত আমি সিলেট প্রত্যাবর্তন করলাম।
আমার বিয়ের আসল কাজ, মানে আকদ, আগেই সম্পন্ন হয়েছিল। সিলেট এসে প্রথমে বউ ঘরে এনে তুললাম। আমার রুজি-রোজগার প্রসঙ্গে দুলা ভাই বললেন, ‘তোমার বউ শুধু খাওয়ার মুখ নিয়ে আসবে না, তার ভাগ্যও সাথে নিয়ে আসবে। সুতরাং চিন্তা করো না। মানুষের রিজিক আল্লাহর হাতে।’
একদিন গেলাম অধ্যাপক ফজলুর রহমানের বাসায়। জিজ্ঞেস করলাম, শাহ জালাল জামেয়ায় চাকরি করতে হলে কি করতে হবে? তিনি বললেন, একখানা সাদা কাগজে দরখাস্ত লেখে প্রিন্সিপালের কাছে পাঠিয়ে দিন, নতুবা আমার কাছে দিয়ে দিবেন। ঠিক আছে বলে চলে এলাম। সে সময় আমার একটা চাকরির খুব দরকার ছিল। তাই দেরি না করে সে দিনই দরখাস্ত লেখে প্রিন্সিপালের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। তখন জামেয়ার প্রিন্সিপাল ছিলেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন চৌধুরী। এরপর শুরু হলো অপেক্ষার পালা। দরখাস্তের কোন জবাব আসে না। প্রায় এক মাস অপেক্ষার পর দেখা করলাম প্রিন্সিপালের সাথে। আমার জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বললেন, ‘ম্যানেজিং কমিটির সভা হয়নি। ম্যানেজিং কমিটির সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। সিদ্ধান্ত হলে তোমাকে জানানো হবে।’ তিনি বয়সে আমার অনেক বড় এবং আদর করে আমাকে তুমি বলতেন। তার জবাব শুনে সন্তুষ্ট চিত্তে এবং অনেক আশা নিয়ে বাসায় চলে এলাম।
ছবি: সাবেক শিবির সভাপতি মুহাম্মদ আবু তাহের (উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট)
ছবি: সাবেক শিবির সভাপতি মুহাম্মদ আবু তাহের (উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট)
কয়েকদিন পর অধ্যাপক ফজলুর রহমান ফোন করে বললেন, ছাত্রশিবিরের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আবু তাহের সিলেট আসছেন। শাহ জালাল জামেয়ার হলরুমে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিবেন। সেখানে যেন আমি অবশ্যই যাই। বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি আসবো।’
অনুষ্ঠানের দিন যথাসময়ে জামেয়ার হলরুমে হাজির হলাম। অনেক দিন পর পুরাতন বহুসাথীর দেখা হলো। আমাকে পেয়ে সবাই খুব খুশি। মাওলানা আবু তাহেরের সাথেও দেখা হলো, কোলাকুলি হলো। কি এক অজানা কারণে প্রোগ্রাম শুরু হতে দেরি হচ্ছে। তাই আমরা বসে বসে খোশগল্প করছি। হঠাৎ দেখলাম অধ্যাপক ফজলুর রহমান মুখ কালো করে আমার কাছে এলেন। বললেন, ‘আপনার সাথে একা একা কথা বলবো, একটু বাইরে আসুন।’ কথামত তার অনুসরন করলাম। বাইরে গিয়ে বললেন, ‘আপনাকে দাওয়াত দিয়েছি, আপনি এসেছেন, এ জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমি খুবই দুঃখিত, আপনি প্রোগ্রামে থাকুন তা মাওলানা আবু তাহের সাহেব চান না। তাই আপনাকে চলে যেতে হবে।’ তার কথার জবাবে বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। আপনি দাওয়াত দিয়েছিলেন বলেই আমি এসেছি।’
আরো কিছুদিন পরের কথা। একদিন রাস্তায় দেখা হলো সিলেট শহর জামাতের এক সদস্যের সাথে। তিনি খুব খোলামেলা লোক। আমাকে বললেন, ‘জামেয়ায় চাকরি হয়নি এ জন্যে মন খারাপ করবেন না। আল্লাহ রেজেকের মালিক।’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জামেয়ায় আমার চাকরি হয়নি, এ কথা আপনি কি ভাবে জানলেন?’ বললেন, জানবো না কেন, আমি তো জামাতে ইসলামীর সদস্য। সদস্য বৈঠকে তা নিয়ে আলাপ হয়েছে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি বলা হয়েছে সেখানে?’ বললেন, ‘বলা হয়েছে, ফরীদ আহমদ রেজা জামাতে ইসলামীর সদস্য নয়। তাই তাকে জামেয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল করা যাবেনা।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন তারিখে সে বৈঠক হয়েছে এবং সেখানে কি ফরীদ উদ্দীন চৌধুরী ছিলেন?’ জবাবে তিনি একটা তারিখ বললেন এবং এটাও বললেন যে সেখানে ফরীদ উদ্দীন চৌধুরী শুধু ছিলেন না, তিনিই ঘোষণাটি দিয়েছেন। হিসেব করে দেখলাম, আমি যে তারিখে ফরীদ উদ্দীন চেীধুরীর সাথে দেখা করেছি এর বেশ আগে সে বৈঠক হয়েছে। জামেয়ার চাকরির ভবিষ্যত আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। খবরটা আমাকে দেয়ার জন্যে ওই সদস্যকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম।
জামেয়ায় চাকরির আশা পরিত্যাগ করে অন্যত্র চাকরি খোঁজার চিন্তা করছি। ইতোমধ্যে একদিন সন্ধ্যার পর অধ্যাপক ফজলুর রহমান আমার বাসায় এসে আমাকে জামেয়ায় নিতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করে যান। এর পর থেকে পত্রিকায় কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখা শুরু করলাম। একদিন দেখলাম, সিলেটের অদূরে অবস্থিত ফেঞ্চুগঞ্জ কলেজে ইংরেজীর শিক্ষক প্রয়োজন। সাথে সাথে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলাম। অধ্যাপক ফজলুর রহমান এক সময় সে কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তার সাথে এ ব্যাপারে মতবিনিময় করলাম। তিনি বললেন, প্রিন্সিপাল জামাতের লোক। তিনি প্রিন্সিপালকে আমার কথা বলে দিবেন। কলেজ থেকে ইন্টারভিউয়ে যাওয়ার জন্যে চিঠি পেলাম। আমার বন্ধু অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস আদিল বললেন, তিনি প্রিন্সিপালকে চেনেন। ইন্টারভিউয়ের আগে আমাকে তিনি তার কাছে নিয়ে যাবেন। তাঁর সাথে আলাপ করে তাঁকে নিয়ে প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করার দিন-তারিখ ঠিক করলাম।
খুব ভোরে আমরা দু জন ট্রেন ধরার জন্যে স্টেশনের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ করে কদমতলীতে দেখা হয়ে গেলো ফরীদ উদ্দীন চৌধুরীর সাথে। তাঁকে পেয়ে একটা কথা জিজ্ঞেস করার লোভ সামলাতে পারলাম না। অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস আদিলকে কিছু না বলে দ্রুত ফরীদ উদ্দীন চৌধুরীর কাছে চলে গেলাম। সালাম বিনিময় করে বললাম, ‘আপনাক একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। আপনারা সদস্য বৈঠকে ঠিক করেছেন, যেহেতু আমি জামাতের সদস্য নই সেহেতু আমাকে জামেয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল করা যাবে না। আপনি কথাটা সরাসরি আমাকে বলতে পারতেন। কিন্তু সত্য কথাটা না বলে আপনি কেন বললেন যে ম্যানেজিং কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে এবং ম্যানেজিং কমিটির বৈঠক এখনো হয়নি?’ আমার প্রশ্নে তিনি খুব বিব্রত হলেন। কি একটা জবাব দেয়ার চেষ্টা করলেন। আমি তাঁর জবাব শোনার অপেক্ষা না করে দ্রুত তাঁর নিকট থেকে সরে গেলাম।
এক সময় ট্রেন স্টেশনে পৌঁছলাম এবং অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস আদিলকে নিয়ে ট্রেনে চড়ে ফেঞ্চুগঞ্জ গেলাম। ফেঞ্চুগঞ্জ কলেজের প্রিন্সিপাল খুব ভালো আপ্যায়ন করলেন। সুন্দর একটা আউটিং হলো। কলেজে ইন্টারভিউয়ের দিন একা একা ফেঞ্চুগঞ্জ গেলাম। আমি-ই একমাত্র চাকরিপ্রার্থী। ইন্টারভিউ প্যানেলে বাইর থেকে এসেছেন এমসি কলেজের এক শিক্ষক। ইন্টারভিউ হলো। আমাকে বলা হলো ফলাফল পরে জানানো হবে। ফেরার পথে ওই শিক্ষকের সাথে আবার দেখা। আমরা একই ট্রেনে সিলেট ফিরছি। তিনি কথায় কথায় বললেন, ‘আপনার চাকরি হবে না।’ কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘প্রিন্সিপাল আপনাকে নিতে চান না।’ আরেকটা নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করলাম।
কয়েক দিন পর দেখলাম চুনারুঘাট কলেজে ইংরেজির শিক্ষক প্রয়োজন। কাউকে কিছু না বলে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলাম। কয়েক দিন পর এক ভদ্রলোক এলেন আমার চা-পাতার দোকনে। বললেন, ‘তিনি ফরীদ আহমদ রেজার সাথে দেখা করতে চান। পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, তিনি চুনারুঘাট কলেজের প্রিন্সিপাল। পরিচয়ের পর বললেন, আপনার দরখাস্ত আমরা পেয়েছি। আমি জানতে এসেছি আপনি কি সত্যি চাকরি করতে চান?’ বললাম, ‘হাঁ, আমি সত্যি চাকরিটি চাই।’ বললেন, ‘তা হলে আমরা আপনাকে ইন্টারভিউয়ের জন্যে ডাকবো।’ যথা সময়ে ইন্টারভিউয়ের চিঠি পেলাম। নির্ধারিত দিনে সেখানে গেলাম। ইন্টারভিউয়ের পর প্রিন্সিপাল বললেন, ‘আমরা আপনাকে চাই। নিয়োগপত্র টাইপ হচ্ছে, এখনই হাতে হাতে পেয়ে যাবেন।’
খুব খুশি লাগলো। জীবনের প্রথম চাকরি। কোন মামা-চাচা ছাড়াই পেয়ে গেলাম। চুনারুঘাট কলেজের তদানীন্তন প্রিন্সিপাল আব্দুল হাইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি শুধু আমাকে চাকরি দিয়েই খুশি করেননি। তিনি, তার স্ত্রী হেলেন ভাবী, চুনারুঘাট কলেজের অন্যান্য শিক্ষক সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। যত দিন সেখানে ছিলাম তারা সবাই আমাকে অত্যন্ত আদর ও সম্মান করেছেন। সপ্তাহে আমার তিন দিন ক্লাস থাকতো। সোমবার সিলেট থেকে চুনারুঘাট গিয়ে কলেজে ক্লাস নিতাম। মংগলবার সেখানে থাকতাম। চুনারুঘাট কলেজের প্রাক্তন এক ছাত্র রাজু। কলেজের অধ্যক্ষ তাদের বাড়িতে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেন। রাজুর মা-বোনদের আদর-আপ্যায়ন এখনো আমার মনকে টানে। বুধবার ক্লাস শেষ করে সিলেট ফিরে আসতাম।
এ দিকে ঢাকায় যুবশিবির গঠনের ফলে সারা দেশে এর পক্ষে-বিপক্ষে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এর খবর সিলেটে বসে পাচ্ছিলাম। জামাতে ইসলামীর পক্ষ থেকে যুবশিবিরের প্রতি যে দুর্ব্যবহার করা হবে এটা জানা ছিল। কিন্তু তা যে এত নিম্নমানের হবে তা ভাবতে পারিনি। তালাবায়ে আরাবিয়া এবং মাওলানা আব্দুর রহীমের প্রতি জামাতের আচরণ ঠিক এ রকমই ছিল। বিরুদ্ধমত বা মতপার্থক্যকে জামাত মোটেই সহ্য করতে পারে না, ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। তারা বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের দমন করতে হেন কাজ নেই যা তারা করতে পারে না। যুবশিবিরের বিরুদ্ধে নানা অকথা-কুকথা ঢাকায় তৈরি হয়েছে এবং জামাত-শিবিরের খালেস-মোখলেস কর্মীরা তা সারা দেশে প্রচার করেছে।
এক সময় সিলেটেও যুবশিবির গঠিত হয়। তবে তুলনামুলক ভাবে সিলেটের জামাতে ইসলামী অনেক উদার ও সহনশীল ছিল। যুবশিবির গঠনের ফলে ছাত্রশিবিরে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, আমার জানা মতে, তা ঢাকা শহর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল সবচেয়ে বেশি। এ সময় সংগঠনে সংহতি ফিরিয়ে আনতে এবং শিবিরকে যুবশিবিরের প্রভাবমুক্ত করার লক্ষ্যে শিবিরের তৎকালীন নেতৃত্ব বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে একটি এই ছিল যে, শিবিরের সাথী যারা হবে তাদের জামাতে ইসলামীকে একমাত্র ইসলামী আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হবে। এর ফলে যারা যুবশিবিরকে পছন্দ করে তারা ছাটাই হয়ে যাবে এবং যারা তাদের প্রতি একটু নমনীয় তারা পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে।
অপরদিকে জামাতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ব্যাপক সফর এবং জনসংযোগ অব্যাহত ছিল। তাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়। সেখানে ইসলামী দল পরিত্যাগ সংক্রান্ত হাদীসসমূহকে যুবশিবিরের বিরুদ্ধে অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় ব্যবহার করা হয়। এ কথা বুঝিয়ে দেয়া হয় যে যারা যুবশিবির করছে তারা দলত্যাগী এবং জাহান্নামী। সাধারণ কর্মীদের সংগঠনে ধরে রাখা এবং তাদের যুবশিবিরের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করার জন্যে এ পুস্তিকা তাদের দৃষ্টিতে ছিল একটা মোক্ষম অস্ত্র। তারা এটা বুঝতে অক্ষম ছিলেন, হাদীসকে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের মাধ্যমে তারা সাধারণ কর্মীদের কাছে কতটা খেলো হয়েছেন।

শিবিরের ক্রান্তিকালঃ ১৯৮২ সালের কথকতা-৫

এক সময় বৈঠক শুরু হলো। দুয়েকটি প্রাথমিক কথা বলে আমি প্রফেসার সাহেবকে তার ফায়সালা ঘোষণা করতে বললাম। তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ ভাষায় যতটুকু সম্ভব মাধুর্য ও আবেগ মিশিয়ে দীর্ঘক্ষণ ভূমিকা দিলেন। তারপর তাঁর ফাইন্ডিংস এবং ফায়সালা শোনালেন। আজ এতদিন পর সব কথা মনে নেই। যতটুকু মনে পড়ে তাঁর সারকথা ছিলঃ
(১) যেহেতু সদস্যদের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে সেহেতু বর্তমান নেতৃত্বকে চলে যেতে হবে। (নোটঃ শাহ জাহান চৌধুরীর এটা দাবি ছিল এবং অনাস্থা এমনিতে সৃষ্টি হয়নি, অনাস্থার জন্যে জামাতের সহযোগিতায় প্রচারণা চালানো হয়েছে।)
(২) অনতিবিলম্বে নতুন নির্বাচন হবে এবং নির্বাচন সম্পন্ন করার কাজে মেম্বার সেক্রেটারী হিসেবে কাজ করবেন নজরুল ইসলাম খাদেম। (নোটঃ কেন নজরুল ইসলাম খাদেমকে তড়িঘড়ি করে বিদেশ থেকে ডেকে আনা হয়েছে তা আমার কাছে পরিস্কার হলো।)
(৩) নির্বাচনের আগে কার্যকরী পরিষদের যারা নিয়মিত ছাত্র নয় তাদের সবাইকে বিদায় নিতে হবে। (নোটঃ তাদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। এর মাধ্যমে, আমরা মিছামিছি ছাত্রত্ব বজায় রেখে জোর করে সংগঠনে রয়েছি, শাহ জাহান চৌধুরীর এ অভিযোগের সত্যতা প্রদান করা হলো।)
(৪) সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বিরোধী কাজ করে শপথ ভঙ্গের কাফফারা হিসেবে শাহ জাহান চৌধুরীকে তওবা করতে হবে এবং তিনটি রোজা রাখতে হবে।
(৫) প্রফেসার সাহেব নিজে এ সকল ফায়সালা সদস্যদের অবহিত করবেন। প্রথমে ঢাকার সদস্যদের জানানো হবে। পরে সারা দেশের সদস্যদের বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে ঢাকায় ডেকে আনা হবে।
প্রফেসার সাহেবের কথা শেষ হলে আমরা সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে সুবোধ বালকের মতো নিজ নিজ বাসায় চলে গেলাম। পরে প্রফেসার সাহেব যখন বিভিন্ন এলাকার সদস্যদের সাথে কথা বলেন তখন আমি মাত্র একটি বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। অন্যগুলোতে আমি ইচ্ছে করেই উপস্থিত হইনি। পরিষদ সদস্যের মধ্যে যারা একাধিক বৈঠকে ছিলেন তারা বলেছেন সকল বৈঠকে তাঁর ভাষা, বাচনভঙ্গী এবং দৃষ্টিকোণ সমান ছিল না। তবে মূল বক্তব্য একই ছিল, বর্তমান ব্যাচের বিদায় এবং শাহ জাহান চৌধুরীর ছেলে ভোলানো তওবা।
আমি যে বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম সেখানে প্রফেসার সাহেব অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে এনেছেন। সেখানে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কোন পরিবেশ বা সুযোগ ছিল না। ৭১ সম্পর্কে তিনি খুব শক্তভাবে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘৭১-এ জামাতের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন উত্তাপনের কোন সুযোগ নেই। ‘৭১ আমাদের ক্রেডেনশিয়েল’
সাইফুল আলম খান মিলন, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি (ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট)
সাইফুল আলম খান মিলন, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি (ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট)
জামাতের প্রত্যক্ষ খবরদারিতে একই সেশনে শিবিরের তিন বার নির্বাচন হলো। তৃতীয় নির্বাচনে সাইফুল আলম খান মিলন কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হলেন। ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ আমাদের বুঝিয়ে দিলেন, ইসলামী পলিটিক্স কাহাকে বলে, এবং তা কত প্রকার ও কি কি। স্বপ্নভঙ্গ বুকে ধারণ করে এখন আমার তল্পিতল্পা গুটিয়ে সিলেট যাবার পালা। আহমদ আব্দুল কাদের, ডাঃ আবিদুর রহমানসহ আরো অনেকে আমাকে ঢাকায় থাকতে বলছেন। প্রিয়ভাজন এডভোকেট এ কে বদরুদ্দোজা আমার জন্যে একটি চাকরিও জোগাড় করে ফেলেছেন, ঢাকার একটা সাপ্তাহিক কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগে। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। আমি আর ঢাকায় থাকবো না।
আমার আজিম পুরের বাসায় তখন অনেকেই আসতেন। সদ্য বিদায়ী কেন্দ্রীয় সভাপতি আহমদ আব্দুল কাদের আসতেন। পরিষদ সদস্যদের মধ্যে আসতেন জসিম উদ্দীন সরকার, আশেক আহমদ জেবাল, মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, মাসুদ মজুমদার প্রমুখ। কিছুদিন আগে বিদায় নেয়া পরিষদ সদস্য ডাঃ আবিদুর রহমানও আসতেন। আমরা নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতাম, সুখ-দুঃখের গল্প করতাম। নিজের কথা বলতে পারি, অনেক অনেক বছর পর এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হলো যে আমার উপর কোন দায়িত্ব নেই। ভালো বা খারপের বিষয় নয়, এ একটা ভিন্নতর অনুভূতি। তবে আমাদের সব আলোচনার মধ্যে ঘুরে ফিরে একটি প্রশ্ন আসতো, এখন আমরা কি করবো?
১৯৭৭ সালে শিবির গঠনের পর একটা বিরাট স্বপ্ন নিয়ে আমরা মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের স্বপ্ন ছিল শিাবরকে বিশেষ কোন দলের নয়, বাংলাদেশের সকল মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলবো। ৭১এর ভুমিকা এবং আলেম সমাজের জামাত বিরোধী মনোভাবের কারণে জামাতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের মনে অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। শুরু থেকে আমরা বলিষ্ঠভাবে বলেছি, শিবির কারো অঙ্গ সংগঠন নয় আমরা জামাত থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে শিবিরকে গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে দিতে পেরেছি। দেশের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আমলা এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে অনেক প্রভাশালী ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যারা জামাতকে পছন্দ করেন না, কিন্তু শিবিরকে ভালোবাসেন। আভ্যন্তরীন এবং বাইরের অনেক বাঁধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে শিবির দিনে দিনে এগিয়ে চলেছে। প্রাক্তন শিবিরকর্মীদের নিয়ে প্রস্তাবিত সংগঠন গড়ে তুলতে পারলে শিবির একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারতো। কিন্তু এখন কি হবে? আমাদের সাথে যা করা হলো এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া শিবিরের উপর পড়বে। শিবির এখন জামাতের ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত হবে এবং আস্তে আস্তে গণমানুষের আস্থা ও সমর্থন হারাবে।
৭১-এ জামাতের ভুমিকার কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সাথে তাদের এক বিরাট দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের মসজিদ-মাদ্রাসায় যে সকল আলেম যুগ যুগ ধরে গণমানুষের ধর্মীয় নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তারা জামাতকে পছন্দ করেন না। জামাতে ইসলামী বাংলাদেশে নতুন নামে কাজ শুরু করলে এ দুটো বাঁধা অতিক্রম করা সহজ ছিল। জামাতে ইসলামী নামটা কুরআন-হাদীস নয় যে একে পরিবর্তন করা যাবেনা। কিন্তু জামাত নাম পরিবর্তন না করে স্বনামেই কাজ শুরু করেছে। নেতৃত্বেও রয়েছেন তারা-ই যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং এ ব্যাপারে জামাতের অবস্থান কোন গোপন বিষয় ছিল না। পরিচিত মুখগুলো-ই আবার নেতৃত্বের আসনে সমাসীন। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ৭১ সালের ভূমিকা জামাতকে সব সময় তাড়া করে বেড়াবে।
আলেম সমাজের সাথে বিরোধও কোন ছোট বিষয় নয়। শেষ ভরসা ছিল ছাত্রশিবির। রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির উর্ধে থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার কারণে শিবির ভিন্ন মতের আলেম সমাজ এবং সুধীদের আশীর্বাদ নিয়ে দ্রুত গতিতে সাধারণ ছাত্রদের মন জয় করছিল। এখন শিবির এর স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে জামাতের সাথে একীভূত হয়ে যাবে। হাজারো কথা আসবে, অসংখ্য দায় এর মাথার উপর এসে পড়বে। একটা সম্ভাবনাময় আন্দোলনকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া হলো। এর কারণ কি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, গোষ্ঠী-স্বার্থ, একগুঁয়েমি, না কি অদূরদর্শিতা আমি জানি না। বাংলাদেশের মানুষের সামনে ইসলামের সঠিক পরিচয় তুলে ধরার মাধ্যমে একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তারা এ ভাবে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে পারে না। ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত পরিণতি ভেবে আমি শঙ্কিত হয়ে পড়লাম।
আমার নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ছিল, আমি জামাতে ইসলামীতে যোগ দেবো না। যাদের মুখের ভাষা এবং বুকের ভাষা এক নয় তাদের সাথে জীবন বাজি রেখে কাজ করা সম্ভব নয়। তবে এ ব্যাপারে আমি কাউকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করিনি। নিজের কথাও নিজের মধ্যেই গোপন রেখেছি। অন্যদের বলেছি, আপনাদের মধ্যে সাহস, যোগ্যতা এবং উদ্দীপনা থাকলে নতুন কিছু করুন। তবে নিছক আল্লাহকে খুশি করার জন্যে, বাংলাদেশের মানুষের জন্যে এবং মানুষকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে। যদি বিকল্প ভালো কিছু করতে পারেন আমার সমর্থন এবং সহযোগিতা পাবেন। কিন্তু উদ্যোগ বা নেতৃত্ব – কোন কিছুতে আমাকে পাবেন না। কারণ আমার মধ্যে সে সামর্থ্য বা উদ্দীপনা নেই। আমি এটাও বলেছি, গণ-সংগঠন না করে যুব সংগঠন করা ভালো। আর ‘যুব শিবির’ নামটা শুনতে চমৎকার শোনায়।
এখানে জেনে রাখা ভালো, শিবিরের তৎকালীন সদস্য-কর্মী বা সাধারণ জনশক্তির সাথে এ সব বিষয়ে আমি ইচ্ছে করেই কোন আলাপ করিনি। কাউকে কোথাও যাওয়ার জন্যে ডাক দিলে নিজেকেও এগিয়ে যেতে হবে। নিজে ঘরে বসে থেকে মানুষকে রাস্তায় নামার জন্যে বলা অর্থহীন। এ কারণেই যুব শিবির গঠনের পর আমি কোন দায়িত্ব গ্রহণ করতে সম্মত হইনি। সে সময় সদস্য-কর্মীদের অনেকে আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। ঢাকার বাইর থেকে কেউ কেউ চিঠি লেখে আমার অভিমত জানতে চেয়েছেন। যেখানে কথা বলতে বাধ্য হয়েছি সেখানে বলেছি, ‘আপনার কবরে আপনি একা যাবেন। সুতরাং সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। তবে যুব শিবিরের প্রতি আমার সমর্থন রয়েছে।’
তখনও ঢাকায় আছি। একদিন ফোন করলেন শিবিরের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আবু তাহের। বললেন, আমার সাথে তার জরুরী কথা আছে। গেলাম তার অফিসে। বললেন, ‘শোনলাম আপনারা যুব সংগঠন করছেন। এটা কি ঠিক?’
বললাম, ‘আমি করছি না। তবে কেউ কেউ করার কথা ভাবছেন। এটা তো নতুন কোন চিন্তা নয়। আপনি যখন সভাপতি ছিলেন তখন আপনার সভাপতিত্বে বিষয়টা নিয়ে পরিষদে আলোচনা হয়েছে এবং তাতে আপনারও সমর্থন ছিল।’
বললেন, ‘সে সময়ের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। বর্তমান সময়ে এটা করা ঠিক নয়। পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে পরে করা যেতে পারে।’
বললাম, ‘যারা যুব সংগঠন করার কথা এখন ভাবছেন, তাদের মতে এখন এর জন্যে চমৎকার সময়।’
বললেন, ‘ঠিক আছে, আমার কথা আমি বললাম। বাকি আপনাদের ইচ্ছা।’
আরেক দিন প্রাক্তন সভাপতি আবু নাসের আব্দুজ জাহের ফোন করলেন। খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। আরো দুয়েক জন ছিলেন। খাওয়া দাওয়ার পর বললেন, ‘তোমাকে জামাতে ইসলামীতে যোগ দিতে হবে।’ বললাম, ‘আমি এ মুহুর্তে জামাতে যোগ দেয়ার কথা ভাবছি না।’ বললেন, ‘যোগ দেবার এখনই উপযুক্ত সময়। আজই যোগ দাও।’ বললাম, ‘আজ-কাল তো নয়-ই। কখনো যদি যোগ দেয়ার কথা ভাবি তা হলে আপনাকে বলবো।’ আমার এ জবাবে তিনি একটু আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন। অনেক কথা বলার পর বললেন, ‘কোন দিন যদি তোমার জামাতে যোগ দেয়ার ইচ্ছ হয় তবে আমাকে অবশ্যই বলবে। মৃত্যু শয্যায় থাকলেও তোমার সাথে আমি যাবো।’
বেশ কয়েক দিন পর ফোন করলেন ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক লস্কর। খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। ইসলামী ব্যাংক নিয়ে তার অনেক আশা এবং স্বপ্নের কথা বললেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছাত্রত্ব তো শেষ। এখন কি করবেন?’ বললাম, ‘সিলেট চলে যাব। সেখানে গিয়ে কি করবো এখনো জানি না।’ বললেন, ‘ইসলামী ব্যাংকে অনেক সম্ভাবনা আছে। আমরা একজন কোম্পানী সেক্রেটারী খুঁজছি। যাকে নিয়োগ করবো তাকে ভালো ইংরেজী জানতে হবে। আমরা তাকে বিদেশ পাঠাবো ট্রেনিং নিতে। আপনি তো ইংরেজীতে অনার্স এবং মাস্টার্স করেছেন। ভালো মনে করলে আমাকে বলবেন। আমি দেখবো আপনার জন্যে কি করা যায়।’ জবাবে আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, প্রয়োজন হলে পরে আপনার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবো।’
অপর একদিন ফোন করলেন, অধ্যাপক ফজলুর রহমান, তখন তিনি সিলেট জেলা জামাতের আমীর। বললেন, আপনার সাথে জরুরী কথা আছে। সময় দিলাম। তিনি আজিমপুরে আমার বাসায় এলেন। অনেক কথা হলো। আমি যখন সিলেটের দায়িত্বশীল তখনো তিনি সিলেটে জামাতের দায়িত্বশীল। তার বাসায় ছাত্রশিবির নিয়মিত প্রোগ্রাম করেছি। তাঁর স্ত্রী খায়রুন্নেসা ভাবী আমাকে খুব আদর-কদর করেন। আমার বিয়ের ঘটকালিও তিনি করেছেন।
অধ্যাপক ফজলুর রহমান আমার ভবিষ্যত পরিকল্পণার কথা জানতে চাইলেন। বললাম, ঢাকায় একটা চাকরির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আমি সিলেটে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। খুব উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘খুব খুশির কথা যে আপনি সিলেট যাওয়ার বিষয় বিবেচনা করছেন। আপনি সিলেট চলে আসুন, আপনাকে শাহ জালাল জামেয়ার প্রিন্সিপাল বানাবো।’
বলালাম, ‘আপনি পারবেন না। ফরীদ উদ্দীন চৌধুরী এর প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। তাকে সরাতে পারবেন না।’
বললেন, ‘এখন আপনাকে প্রিন্সিপাল নয়, ভাইস প্রিন্সিপাল করবো। ফরীদ চৌধুরকে সংগঠনের জন্যে প্রয়োজন। তাই আমরা যোগ্য ভাইস প্রিন্সিপাল খুঁজছি। সেই ভাইস প্রিন্সিপালের উপরই পরে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব দেবো। ’
বললাম, ‘ঠিক আছে। আগে সিলেট আসি, তারপর দেখা যাবে। ’

শিবিরের ক্রান্তিকালঃ১৯৮২ সালের কথকতা-৪

পরিস্থিতি বোঝার জন্যে ঢাকা শহরে যারা অনাস্থাপত্র পাঠিয়েছে তাদের কয়েকজনকে আমি ডেকে আনলাম। পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করলাম। জিজ্ঞাস করলাম, কি ব্যাপার? হঠাৎ করে গোটা দেশের সদস্যরা এমন সংগঠন-সচেতন হয়ে উঠলো কেন? কেউ কেউ মিউ মিউ করে জবাব দিলেন। কেউ এড়িয়ে গেলেন। সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের অনেক কথা বলার পর বললেন, ‘আমি শাহজাহান চৌধুরীর চিঠি পেয়ে মতিউর রহমান নিজামীর সাথে আলাপ করেছি। তিনি যে ভাবে জবাব দিয়েছেন এতে বুঝেছি এ ব্যাপারে তার সম্মতি রয়েছে। এ কারণেই আমি এর সাথে জড়িত হয়েছি।’ বিশ্বস্ত সূত্রে আরো খবর পেলাম, শাহ জাহান চৌধুরীর চিঠি নিয়ে ছাত্রশিবিরের কিছু বর্তমান এবং প্রাক্তন সদস্য বিভিন্ন শহরে গিয়ে দ্রুত অনাস্থা প্রস্তাব প্রেরণের জন্যে শিবিরের সদস্যদের তাগিদ দিয়েছেন। যারা গিয়েছেন তাদের অনেকের নাম জেনে বিস্মিত হয়েছি। কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের সাথে আমার ঘনিষ্টতা ছিল। অনেককে আমি নিজ হাতে গড়েছি।
ঘটনার আকস্মিতা এবং জটিলতা ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে মানসিক ভাবে অত্যন্ত বিপর্যস্থ করে তুলে। ধীর-স্থির ভাবে ঘটনবলীর বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে মানসিক যে শক্তির প্রয়োজন তা মোটেই পাচ্ছিলাম না। কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং ঢাকায় অবস্থানরত পরিষদ সদস্য জসীম উদ্দীন সরকার, মাসুদ মজুমদার, আশেক আহমদ জেবাল, আনোয়ার হোসেন প্রমুখের সাথে কথা হচ্ছিল। তাদের কথা শুনছিলাম, কিন্তু কাউকে কোন পরামর্শ দেয়ার মতো মনের জোর ছিল না। সাংগঠনিক নিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সভাপতি কার্যকরী পরিষদের জরুরী বৈঠক আহ্বান করলেন। বৈঠকের দিন দেখলাম সাংগঠনিক কাজে বিদেশে অবস্থানরত পরিষদ সদস্য নজরুল ইসলাম খাদেম বিদেশ থেকে তড়িঘড়ি করে ফিরে এসে বৈঠকে হাজির হয়েছেন।
বৈঠক শুরুর পরই সকলের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বললেন, ‘বর্তমান জটিল অবস্থার সমাধান করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সমস্যা সমাধানের সকল দায়িত্ব আমীরে জামাতের উপর ছেড়ে দেয়া হোক।’ মুজাহিদুল ইসলামের প্রস্তাব শুনে আমি বিস্মিত হলাম। তিনি জানেন, ঘটনার সাথে জামাতের কেউ কেউ জড়িত আছেন। আমীরে জামাতের সম্মতি ছাড়া জামাতে ইসলামীর নেতা বা সদস্য এ রকম একটা অসাংগঠনিক কাজে জড়িত হবে তা ভাবা যায় না। পরে ভেবেছি, মুজাহিদুল ইসলাম হয়তো মনে করেছেন, আমীরে জামাত খালেস-মুখলিস মানুষ। তাঁকে অন্ধকারে রেখে বা ভুল বুঝিয়ে জামাতের দ্বিতীয় সারির নেতৃবৃন্দ এ কাজটি সম্পন্ন করেছেন। তিনি মনে করেছেন, সকল কথা শোনার পর আমীরে জামাতের ভুল ধারণা দূর হবে এবং তিনি দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
আমার ব্যক্তিগত চিন্তা ছিল, প্রথমে আমরা সংগঠনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণে শাহ জাহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেব। তারপর শিবিরের বর্তমান এবং প্রাক্তন সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটা শক্তিশালী কমিটির উপর পুরো ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব অর্পন করবো। কিন্তু মুজাহিদুল ইসলামের প্রস্তাব শোনার পর কতিপয় পরিষদ সদস্য খুব উৎসাহ নিয়ে তা সমর্থন করে বসলেন। কেন্দ্রীয় সভাপতিও এ ব্যাপারে ইতিবাচক কথা বললেন। সদস্যদের মনোভাব প্রত্যক্ষ করে আমি আমার প্রস্তাব উত্থাপন করা থেকে বিরত থাকলাম। ভাবলাম, আমার প্রস্তাব শুনে কেউ ভাবতে পারে যে আমি আমীরে জামাতের উপর অনাস্থা প্রকাশ করছি। তাই সর্বসম্মত ভাবে মুজাহিদুল ইসলামের প্রস্তাব পাশ হয়ে গেলো। আমীরে জামাতকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা এবং তাঁকে পরিষদের প্রস্তাব পৌছে দেয়ার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সভাপতি আহমদ আব্দুল কাদের এবং সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে আমার উপর প্রদান করা হলো।
যতটুকু মনে পড়ে পরদিনই আমরা অধ্যাপক গোলাম আযমের সাথে দেখা করতে যাই। তাঁর সাথে প্রায় ঘন্টা দুয়েক আলাপ হয়। প্রথমেই তিনি বললেন, ‘ঘটনা শোনার পর আমি অস্থির হয়ে পড়েছি।’ তাঁর সাথে মূলতঃ কেন্দ্রীয় সভাপতিই কথা বললেন। আমি শুধু এটা ওটা যোগ করলাম। ঘটনার সাথে জামাতের লোকদের জড়িত থাকার কথা আমরা জোর দিয়ে বললাম। আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের আমাকে নিজামী সাহেব সম্পর্কে যে কথা বলেছিলেন তাও বললাম। তিনি অখন্ড মনযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনলেন। তারপর বললেন, ‘তোমরা যখন বলছো, আমি বিষয়টার দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। দেরি না করে এখনই কাজ শুরু করে দেবো। অনেকের সাথে আলাপ করতে হবে। তোমাদের সাথেও আরো আলাপ হবে।’
আমরা সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁর বাসা থেকে ফিরে এলাম।
কয়েকদিন পর প্রফেসার সাহেব আমাকে যাওয়ার জন্যে খবর দিলেন। যথাসময়ে আমি গেলাম। কিছু খুচরা আলাপের পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ ঘটনার আসল কারণ কি?’
আমি বললাম, ‘আমার মতে আমি সেক্রেটারী জেনারেল হওয়ার কারণেই এমনটি ঘটেছে। কিছু লোক চায়নি আমি সেক্রেটারী জেনারেল হই।’
তিনি বললেন, ‘তোমার হওয়ার কারণে জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। মিলন না হওয়ার কারণে হয়েছে।’
আমি বললাম, ‘কথা তো একটা-ই।’
তিনি বললেন, ‘আর কি কারণ থাকতে পারে?’
আমি বললাম, ‘আমি আর কোন কারণ জানি না। শাহ জাহান চৌধুরী যা বলেছে তাতে সত্যের লেশমাত্র নেই। মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকতে পারে। তা দূর করার পথও আছে। কিন্তু যা করা হয়েছে তা জঘন্য।’
তিনি বললেন, ‘আমি তা দেখবো।’
প্রায় ঘন্টা খানেক তার সাথে আরো নানা কথা হলো। কথায় কথায় আমাকে বললেন, ‘আগে তোমাকে নিয়ে আমার সুনামগঞ্জ কেন্দ্রিক চিন্তা ছিল। সেক্রেটারী জেনারেল হওয়ার পর তোমাকে নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রিক চিন্তা শুরু করেছি।’
সব শেষে বললেন, ‘আব্দুল্লাহ তাহেরের বরাতে তুমি যে কথা বলেছিলে তা আমি নিজামী সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছি। তিনি বলেছেন তাহেরকে তিনি এ ধরণের কোন কথা বলেননি।’
প্রফেসার সাহেবের নিকট থেকে ফিরে আসার পর শুরু হলো অপেক্ষার পালা। অপর দিকে নানা রকম গুজব এবং কানাকানির খবরও কানে আসতে লাগলো। মাওলানা আব্দুল জাব্বারের কথা শুনলাম। জামাতের কর্ম পরিষদের সিদ্ধান্তের কথা শুনলাম। আমি কখনো এ সকল কথা যাচাই করার জন্যে মাওলানা আব্দুল জাব্বারের সাথে দেখা করতে যাইনি। আহমদ আব্দুল কাদেরকে তিনি বলেছেন। অবশ্য সকল কানাকানির খবর আমার কানে আসতো না। শিবিরের কলাবাগানের মেস ছেড়ে আমি চলে এসেছিলাম। তখন আমি থাকতাম আজিমপুরে, ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বন্ধুবর হাফিজ আব্দুশ শাকুরের বাসায়। আলু বাজার মেস বা কলাবাগান মেসে গেলে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে সদস্য-কর্মীদের সাথে দেখা হতো।
ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনের কারণে এ সকল এলাকার সদস্যদের অনেকে আমার সাথে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলতে চেয়েছেন। অনেকে আমার সাথে কথা বলার জন্যে আজিম পুরে পর্যন্ত এসেছেন। অনেকে আমাকে এ বলে অভিযুক্ত করেছে যে, কতকিছু ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু এখনো আমি মুখ খুলছি না কেন? সেই ক্রান্তিলগ্নেও কারো সাথে আমি অসাংগঠনিক কোন কথা বলিনি, আমার বলার ইচ্ছে হয়নি। একজন শাহ জাহান চৌধুরীর কারণে সাংগঠনিক শৃঙ্খলায় অভ্যস্থ ফরীদ আহমদ রেজা তার শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারে না। তাই আমার কথাবার্তা যা হয়েছে কার্যকরী পরিষদ সদস্যদের সাথে।
একদিন পরিষদ সদস্য আনোয়ার হোসেন, যিনি ঢাকা শহরে আমার সেক্রেটারী ছিলেন, আমাকে বললেন, ‘এটা আপনারা কি করলেন? সকল দায়িত্ব আমীরে জামাতের হাতে তুলে দিলেন? তিনি কি কিছু করতে পারবেন?’ আমি বললাম, ‘দেখা যাক কি হয়?’ তিনি বললেন, ‘এক কাজ করেন। প্রফেসার সাব, আপনি আর আহমদ আব্দুল কাদের, এ তিন জন মিলে একটা দল গঠন করেন। তা হলে জমবে ভালো।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ কথার মানে কি? কি জন্যে এ কথা বলছেন?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আপনারা তিনজনই খুব সহজ সরল। পৃথিবী এ রকম নয়।’
দীর্ঘ অপেক্ষার পর সে দিন এলো যে দিন প্রফেসার সাহেব তার রায় ঘোষণা করবেন বলে ঠিক হয়েছিল। আমরা পরিষদ সদস্যরা ইবনে সিনা ক্লিনিকের একটি কামরায় জড়ো হলাম। কে একজন আমাকে বললেন, সম্ভবতঃ আলী আহসান মুজাহিদ, ‘যেহেতু কেন্দ্রেীয় সভাপতির উপর অনাস্থা তাই আজকের বৈঠক আপনার সভাপতিত্বে হওয়া দরকার।’ কেন্দ্রীয় সভাপতিও আমাকে বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনি-ই সভা পরিচালনা করুন।’
চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে প্রফেসার সাহেব আমার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাইলেন। আমরা দু জন একটা কামরায় গিয়ে বসলাম। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই;
শুনলাম তোমরা নাকি ৭১এর পর্যালোচনা করতে চাও। এটা কি ঠিক?
আমি বললাম, ‘ঠিক। আমরা জানতে চাই কোন পরিস্থিতিতে এবং কেন জামাত ৭১ সালে পাকিস্তানীসামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।’
– এটা কে করবে?
– করবেন আপনারা, যারা সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত ছিলেন। আমরাও থাকবো। তবে পূর্বাপর ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা আপনাদের দিতে হবে। আমরা তো তখন ছিলাম না। তাই অনেক কিছু আমাদের সরাসরি জানা নেই। আমরা জানতে চাই ৭১ সালে কেন পাকিস্তানী মিলিটারীদের সহযোগিতা করা হয়েছে? কেন এবং কোথায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে? এর ফলে কী লাভ-ক্ষতি হয়েছে? এ সকল বিষয় পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে জনশক্তি এবং জনগণকে অবহিত করতে হবে।
– জামাত যদি এ পর্যালোচনায় শরিক থাকে তা হলে তো খারাপ কিছু নয়।
আচ্ছা বলতো, তোমরা যুব সংগঠন কেন করতে চাও?
– যুব সংগঠন করতে চাই প্রাক্তন শিবির কর্মীদের ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্যে। কারণ ছাত্র জীবন শেষ হবার পর তারা অনেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এ সেশনে আমরা তা নিয়ে আলোচনা করিনি। কয়েক বছর আগে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল এবং আলী আহসান মুজাহিদ তখন এ ব্যাপারে খুব উৎসাহ দেখিয়েছেন।
– এটা কে করবে?
– সাবেক শিবির-সদস্যরা তা করবেন। জামাতকেও সহযোগিতা করতে হবে।
– এটাও খুব ভালো জিনিস।
আরেকটা প্রশ্ন। বলতো, শিবিরের সংবিধানে সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগের ধারায় সংশোধন না আনলেই কি নয়? এটা না করলে চলে না?
– প্র্যাকটিস এবং ব্যাখ্যার মধ্যে পরিবর্তন হলে যে ভাষায় তা লেখা আছে তাতেই চলবে। একজন সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন। পরে তিনি এটা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সাংগঠনিক সেশনের শেষের দিকে তা আবার আসতে পারে। আপনি বললে সংশোধনী প্রস্তাব যাতে না আসে, আমি সে চেষ্টা করবো।
এ যদি হয় তা হলে আহমদ আব্দুল কাদের সভাপতি থাকতে পারে। তোমরাও থাকতে পারো। ঠিক আছে, আমি নিজামী সাহেবের সাথে একটু আলাপ করে নেই। এ কথা বলে প্রফেসার সাহেব অন্য কামরায় উঠে গেলেন যেখানে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ প্রমুখ বসা ছিলেন।
কিছুক্ষণ পর আলী আহসান মুজাহিদ এসে বললেন, ‘প্রফেসার সাহেব আপনাকে যে কথা বলেছেন তা এখন সম্ভব নয়। যে ভাবে বিষয়টার সমাধান হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে সে ভাবেই হবে, এখন এতে কোন পরিবর্তন করা যাবে না।’ প্রফেসার সাহেবের প্রশ্ন থেকে আমি বুঝতে পারলাম আমাদের বিরুদ্ধে কি কথা বলে তাঁকে প্রভাবিত করা হয়েছে। অপরদিকে আলী আহসান মুজাহিদের কথা থেকে আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেলো কি ফায়সালা আসছে এবং এ ফায়সালা কারা তৈরি করেছেন।

বিরাশি সালের কথকতা-3

ঢাকার কলাবাগানে অবস্থিত শিবিরের মেসে আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। ছাত্রত্ব বজায় রাখার জন্যে ঢাকা ল কলেজে আইন পড়তে ভর্তি হলাম। নির্বাচন হলো এবং আমাকে ঢাকা শহরের সভাপতি নির্বাচিত করা হলো। ঢাকা শহরের অধিকাংশ সদস্যের পরামর্শের আলোকে সেক্রেটারী নিয়োগ করলাম কার্যকরী পরিষদের নতুন সদস্য আনোয়ার হোসেনকে। অত্যন্ত কর্মঠ, বুদ্ধিমান, অভিজ্ঞ এবং বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তিকে সেক্রেটারী হিসেবে পেয়ে খুব ভালো লাগলো।
শিবিরের দুই সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ৮২ সালে কর্মপরিষদ সদস্য (ছবি: গুগুল থেকে নেয়া)
কর্মপরিষদে পেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, সলিমুল্লাহ মেডিকেলের আমিনুল ইসলাম মুকুল, কলেজসমূহের ইনচার্জ আব্দুল হক এবং অন্যান্য জোনের দায়িত্বশীলদের। তাদের সহযোগিতা, আন্তরিকতা এবং যোগ্যতা প্রশ্নের উর্ধে ছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম, ছয় মাস পর আমি চলে গেলে এরা যে কেউ যোগ্যতার সাথে ঢাকা শহর পরিচালনা করতে পারবেন। বার্ষিক পরিকল্পণা গ্রহণ করলাম। সকল থানা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সফর করলাম। নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হলো। কিন্তু কি জানতো আমার জন্যে আরো কিছু বিস্ময়কর ঘটনা অপেক্ষা করছে।
একদিন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ আমাকে ডেকে পাঠালেন। ভূমিকা হিসেবে অনেক কথা বলার পর শেষে বললেন, ‘এনামুল হক মনজু ব্যক্তিগত কারণে কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করবেন। আমি যেন ঢাকায় অবস্থানরত পরিষদ সদস্যদের সাথে আলাপ করে তাদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত করি। এর কোন বিকল্প নেই। দ্রুত এর ব্যবস্থা করুন।’ আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঢাকার পরিষদ সদস্যদের ডাকলাম। বিষয়টা ব্যাখ্যা করলাম। তারা সবাই কারণ জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘কারণ ব্যক্তিগত। এর চেয়ে বেশি কিছু আমি বলতে পারবো না।’ তারা অনেক চাপাচাপি করলেন। বললেন, ‘কেন্দ্রীয় সভাপতি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করতে চাইলে করবেন। আমরা কারণ জানতে চাই এ জন্যে যে তা হলে হয়তো কারণ দূর করার একটা পথ আমরা খুঁজে পেতে পারি।’ আমি বললাম, ‘প্রয়োজন হলে আপনারা পরিষদের বৈঠকে তাকে কারণ জিজ্ঞেস করবেন। তবে আমার অনুরোধ, বৈঠকে আপনারা পদত্যাগের কারণ জানতে বা তা প্রত্যাহার করার জন্যে বেশি চাপাচাপি করবেন না।’ দুয়েক দিনের মধ্যে পরিষদের বৈঠক ডাকা হলো। বৈঠকে এনামুল হক মনজু পদত্যাগ করলেন। উপস্থিত সদস্যরা আমার অনুরোধ আমলে না নিয়ে কারণ জানতে এবং পদত্যাগ না করতে অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্ত এনামুল হক মনজু তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।
কেন্দ্রীয় সভাপতি পদত্যাগের পর সংবিধান অনুযায়ী পরিষদের সদস্যদের ভোটে আহমদ আব্দুল কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। এ বৈঠকেই পরবর্তী কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচন সম্পন্ন হয় এবং সারা দেশের সদস্যদের ভোটে আহমদ আব্দুল কাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
আহমেদ আব্দুল কাদের বাচ্চু, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি (ছবি উৎস: গুগুল)
আহমদ আব্দুল কাদের, সাবেক সভাপতি, ছাত্র শিবির তখন ও এখন (ছবি: গুগুল থেকে নেয়া)
আহমদ আব্দুল কাদের সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগের জন্যে পরিষদের সদস্যদের সাথে পরামর্শ শুরু করলেন। আমি তাকে প্রস্তাব দিলাম, ‘আপনি সাইফুল আলম খান মিলনকে সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে রাখুন। মেয়াদ শেষ হবার আগে তাঁকে বাদ দেয়া ভালো দেখায় না’ তিনি বললেন, ‘আপনার পরামর্শ শুনলাম। তবে অধিকাংশ পরিষদ সদস্য যার পক্ষে মতামত দিবেন তাকেই আমি সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দিতে চাই।’ আমি বললাম, ‘আর যা-ই করুন, আমাকে সেক্রেটারী জেনারেল করবেন না। আমার ছয় মাসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন ঢাকা শহরের জন্য নতুন সভাপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে আমাকে বিদায় দেন।’ তিনি বললেন, ‘দেখা যাক পরিষদ সদস্যরা কি বলেন।’
এক সময় পরিষদের বৈঠক শুরু হলো। প্রথম এজেন্ডা সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগ। আহমদ আব্দুল কাদের বৈঠক শুরু করেই বললেন, ‘আমি অধিকাংশ পরিষদ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে ফরীদ আহমদ রেজার নাম ঘোষণা করছি।’ ঘোষণা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না। অন্যরা আলহামদুলিল্লাহ বলে ঘোষণাকে স্বাগত জানালেন। বৈঠকে ঠিক আমার পাশে বসেছিলেন সাইফুল আলম খান মিলন। চেয়ে দেখলাম তার ফর্সামুখ, হয়তো রাগে-দুঃখে, লাল হয়ে গেছে। পরক্ষণেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং কাউকে কিছু না বলে ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। সবাই সেটা দেখেও না দেখার ভান করলেন। কেন্দ্রীয় সভাপতি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকলেন। তারপর পরিষদের বৈঠক সেখানেই মুলতবী ঘোষণা করলেন।
সাইফুল আলম খান মিলন, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি (ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট)
পরে এক সময় আমি ফোন করলাম সাইফুল আলম খান মিলনকে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি যে ভাবে রাগ করে এবং কাউকে কিছু না বলে পরিষদের বৈঠক থেকে বেরিয়ে গেলেন, তা কি ঠিক হয়েছে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘না ঠিক হয়নি। কিন্তু আমি সহ্য করতে পারিনি। এ জন্যে বেরিয়ে গেছি।’
৮২ তে ফরিদ আহমেদ রেজা
৮২ তে ফরিদ আহমেদ রেজা
পরদিন পরিষদের বৈঠক শুরু হলে সাইফুল আলম খান মিলনের সে দিন বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে আমি বললাম, ‘আমার সাথে তাঁর আলাপ হয়েছে, তিনি স্বীকার করেছেন এটা ঠিক হয়নি। সুতরাং এ বিষয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো।’ আমার এ অনুরোধ কারো কারো মনঃপুত না হলেও অধিকাংশ সদস্য মেনে নেন। নির্বাচন এবং দায়িত্ব বন্টন সম্পন্ন হবার পর সংগঠনের নিয়মিত কাজের দিকে আমরা মন দিলাম।
হঠাৎ একদিন কে একজন খবর দিলেন, শাহ জাহান চৌধুরী (মোমেনশাহী) গোটা দেশের সদস্যদের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, শিবিরের বর্তমান নেতৃত্ব সংগঠনের মূল আদর্শ থেকে সরে গেছে। কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা ছাত্রজীবন শেষ হবার পরও শিবির ত্যাগ করছে না। তারা ষড়যন্ত্র করে কেন্দ্রীয় সভাপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করে নেতৃত্ব দখল করে নিয়েছে। সে চিঠিতে সদস্যদের প্রতি আবেদন জানানো হয়েছে, তারা যেন সংগঠন রক্ষার তাগিদে বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে। এ চিঠির খবর পাওয়ার সাথে সাথে, আমাদের অবাক করে দিয়ে ঢাকা, সিলেট, চট্রগ্রাম, রাজশাহী প্রভৃতি এলাকা থেকে সদস্যদের দস্তখত সম্বলিত অনাস্থাপত্র আসা শুরু হয়। আমরা বুঝলাম যে একটা সুচিন্তিত পরিকল্পণা, সুসংবদ্ধ জনবল এবং আনুষঙ্গিক উপায় উপকরণ ছাড়া সারা দেশে এত দ্রুততার সাথে চিঠি প্রেরণ এবং অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।
(চলবে)

বিরাশি সালের কথকতা-২

কার্যকরী পরিষদের বৈঠকে ঢাকায় গেলাম। কেন্দ্রিয় সভাপতি বললেন, ‘ঢাকা শহরে যোগ্য লোক নেই। সভাপতি বিদায় নিয়েছেন। সেখানে এখন যারা আছেন, তাদের উপর ভরসা করা যায় না।’ আমি কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বললাম, ‘তাদের মধ্যে যে কেউ ঢাকা শহরকে যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করতে পারবেন। নতুবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অমুক এবং অমুককে নিয়ে আসুন।’ তিনি আমতা আমতা করলেন। বুঝলাম আমি যাদের নাম বলেছি ওরা তাঁর পছন্দের লোক নয়। এ ধরণের সাবজক্টিভ মনোভাব আমার একদম ভালো লাগে না। অনেকক্ষণ আলাপের পরও কোন ফায়সালা হলো না। বিরতি দেয়া হলো।
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সভাপতি পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘ (ছবি: গুগুল থেকে নেয়া)
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সভাপতি পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘ (ছবি: গুগুল থেকে নেয়া)
বিরতির সময় আলী আহসান মুজাহিদ এসে বললেন, আপনার সাথে একান্তে কিছু কথা আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি কথা?’ তিনি বললেন, ‘আপনাকে ঢাকা শহরে মাত্র ছয়টা মাস সময় দিতে হবে। তারপর আপনার ছুটি। আপনাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি অন্য কাউকে ঢাকা শহরে দিয়ে স্বস্তি পাবেন না। আপনি দীর্ঘ দিন সংগঠনের জন্যে কাজ করেছেন, আরো ছয়টা মাস ছাত্রশিবিরে থাকুন।’
আমি বললাম, ‘এটা সম্ভব নয়। আমাকে ছাত্রজীবন শেষ করতে হবে। চট্টগ্রাম শহরের বোঝা আমার ঘাড়ে দেয়া হয়েছিল একটা বিপজ্জনক ক্রান্তি লগ্নে। সেটা যতটুকু পারি বহন করেছি। চট্টগ্রাম শহর এখন নিজে নিজে চলতে পারবে। চট্টলায় যোগ্য লোকের অভাব ছিল না। শুধু ছিল আত্মবিশ্বাসের অভাব। এক বছরে তাদের নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের নির্বাচনের পর-ই আমি সিলেট চলে যাবো। আমার আব্বা-আম্মার বয়স হয়েছে। আমি তাদের বড় ছেলে। আমাকে তাদের দেখতে হবে।’
আমি আরো বললাম, ‘আমার অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়নি। আশা ছিল এম এ পরীক্ষায় সেটা পোষিয়ে নেব। কিন্তু আমাকে শান্তিতে এম এ পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়নি। আমার মনে আছে, পরীক্ষার এক মাস আগে সাংগঠনিক কাজ থেকে বিদায় নিয়ে দরজা বন্ধ করে পড়তে বসেছি। তখন চট্টগ্রাম শহরের সিনিয়র সদস্যরা একযোগে এসে বলেছেন, হয় সভাপতির পরীক্ষা হবে, নতুবা চট্টগ্রাম কলেজের নির্বাচন হবে। দুটো এক সাথে করা সম্ভব নয়। আপনি ফায়সালা দেন কোনটা হবে। টেবিলের উপর খোলা বই বন্ধ করে বলেছি, এম এ পরীক্ষা হোক বা না হোক, চট্টগ্রাম কলেজের নির্বাচন হবে। এখন থেকে আমার ছুটি বাতিল। এই ভাবে আমি এমএ পরীক্ষা দিয়েছি। এখন এমএ পরীক্ষার ফলাফল যাই হোক, আমি আর ছাত্রশিবিরে নেই।’
তিনি আমার কথার জবাবে অনেক কথা বললেন। সেখানে অনেক অযৌক্তিক এবং আবেগময় কথা ছিল। সব কথার সার কথা, ছ মাসের জন্যে আমাকে ঢাকা শহরে কাজ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত তাঁর কথা ফেলতে পারলাম না। বললাম, ‘ঠিক আছে। মনে থাকে যেন মাত্র ছয় মাস, এ থেকে একদিনও বেশি নয়।’ এ ভাবেই আমাকে চট্টগ্রাম শহর থেকে সিলেটে প্রত্যাবর্তন না করে ঢাকায় আসতে হয়।
একই বৈঠকে আরেকটি ঘটনা ঘটে। ছাত্রশিবিরের সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হবার পর কার্যকরী পরিষদ সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগ করেন। এখানে ‘পরামর্শ করে’ কথাটার ভাষাগত অর্থ হচ্ছে পরামর্শ অনুযায়ীএর ব্যবহারিক বা প্রচলিত অর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সভাপতি পরামর্শ করবেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশের পরামর্শ গ্রহণ করা তাঁর জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। এই প্রচলিত ব্যাখ্যা সেই শুরু থেকে আমরা শুনে আসছি এবং কেউ এটাকে চ্যালেঞ্জ করেনি বা এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে আলোচনা হয়নি। কিন্তু আমাদের অনেকের পর্যবেক্ষণ ছিল, যে ভাবে সাংবিধানিক এ সুযোগকে ব্যবহার করা হচ্ছে তা নানা কারণে সঠিক হচ্ছে না।
ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট
ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট
এনামুল হক মনজু কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হবার পর প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তিনি পরিষদের সদস্যদের সাথে পরামর্শ করেন এবং সাইফুল আলম মিলনকে সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগ করেন। এটা অনেকের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। ইতোপূর্বে যারা সেক্রেটারী জেনারেল হয়েছেন তারা এক, দুই বা তিন নম্বর চয়েসের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার বিচারে সাইফুল আলম মিলনের অবস্থান ছিল অনেক পেছনে। প্রশ্ন জেগেছে, কেন তাকে সেক্রেটারী জেনারেল করা হলো? কয়েক বছর থেকে দেখা যাচ্ছে, যিনি সেক্রেটারী জেনারেল নিযুক্ত হন পরবর্তীতে তিনি কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। তা হলে কি পর্দার অন্তরালে থেকে কেউ নিজেদের পছন্দমত কেন্দ্রীয় সভাপতি বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন করছে?
এর একটা জবাব আমার কাছে ছিল, যদিও সে সময় আমি কাউকে তা বলিনি। এনামুল হক মনজু কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হবার পর কাকে সেক্রেটারী জেনারেল করা যায় তা নিয়ে আমি সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথে পরামর্শ করতে চেয়েছি। তিনি প্রথমে আমাকে কিছু বলতে চাননি। অনেক চাপাচাপি করার পর বলেছেন, ‘এটা আপনাদের ব্যাপার। যাকে ইচ্ছা আপনি প্রস্তাব করতে পারেন।’
শহীদ কামারুজ্জামান, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি (ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট)
শহীদ কামারুজ্জামান, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি (ছবি উৎস: ছাত্র শিবির ওয়েবসাইট)
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘অমুক বা অমুক হলে কেমন হয়?’
তিনি বললেন, ‘বাইরে আছেন এমন কাউকে নিয়ে চিন্তা করুন।’
আমি বললাম, ‘কে এমন যোগ্য লোক যিনি বাইরে আছেন?’
তিনি বললেন, ‘কেন, সাইফুল আলম খান মিলন বাইরে আছেন।’
উল্লেখ্য যে তখন সাইফুল আলম খানকে সংগঠনের পক্ষ থেকে হজ্বে পাঠানো হয়েছিল।
আমি বললাম, ‘এটা হয় না। তার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ ও যোগ্য লোক আছেন।’ আমার জবাব শুনে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। তার সাথে কথা আর এগোয়নি।
পরে যখন সাইফুল আলম খান মিলনকে সেক্রেটারী জেনারেল করা হলো, আমি বুঝলাম তিনি প্রাক্তন সভাপতিদের বাছাইকৃত ব্যক্তি। এ ঘটনা পরিষদ সদস্যদের মধ্যে সংবিধানের এ ধারা পূনর্বিবেচনার চিন্তা জাগ্রত করে। মনে হয় এ কারণেই পরিষদের পরবর্তী বৈঠকে সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগের এ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আশেক আহমদ জেবাল উত্থাপন করেন। ‘মনে হয়’ এ জন্যে বলছি, আশেক আহমদ জেবালের সাথে এ নিয়ে আমার কোন আলাপ হয়নি। যদিও প্রচারণা রয়েছে, আমরা সবাই মিলে এ সংশোধনী এনেছি। তার সংশোধিত প্রস্তাব ছিল, কেন্দ্রীয় সভাপতি পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগ করবেন।
প্রস্তাবিত সংশোধনী উত্থাপিত হবার পর দেখা গেলো দুয়েকজন ছাড়া পরিষদের আর সবাই সংশোধীনর পক্ষে মতামত রাখছেন। প্রাক্তন সভাপতি হিসেবে আলী আহসান মুজাহিদ সে বৈঠকে ছিলেন। তিনি এবং কেন্দ্রীয় সভাপতি বার কয়েক প্রচলিত ধারার পক্ষে বক্তব্য রাখার পরও দেখা গেল অধিকাংশ পরিষদ সদস্য সংশোধনীর পক্ষে রয়েছেন। তখন কেন্দ্রীয় সভাপতি বৈঠক মূলতবী করে দেন। তারপর একান্তে মন্তব্য করেন, যদি এ সংশোধনী পাশ হয় তা হলে তার পক্ষে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।
বিরতির সময় আবার আলী আহসান মুজাহিদ আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘সংশোধনী পাশ হলে এনামুল হক মনজু পদত্যাগ করবেন। এটা কি ভালো হবে?’ আমি বললাম, ‘না এটা ভালো হবে না। আপনি এনামুল হক মনজুকে বোঝান, অধিকাংশ সদস্যের মতামত মেনে নেয়ার জন্যে।’ তিনি বললেন, ‘বুঝিয়ে লাভ হবে না। আপনি একটা পথ খুঁজে বের করুন।’ আমি বললাম, ‘সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী সভাপতি অধিকাংশের মত মেনে নেবেন। এটাই তো বিধান।’ তিনি বললেন, ‘তা হবে না।’ তখন আমি বললাম ‘এ অবস্থায় আমি আশেক আহমদ জেবালকে সংশোধনী প্রস্তাব প্রত্যাহার করার জন্যে অনুরোধ করে দেখতে পারি।’ তিনি বললেন, ‘তাই করুন। জেবাল এক সময় আপনার কর্মী ছিলেন, তিনি আপনার কথা শুনবেন।’
সে অনুযায়ী আমি জেবালের সাথে আলাপ করলাম। অচলাবস্থার জটিল প্রকৃতি এবং এর সাংবিধানিক পরিণতি ব্যাখ্যা করে বললাম, ‘আপাততঃ আপনার সংশোধনী প্রত্যাহার করে নেন। প্রয়োজন হলে বছরের শেষের দিকে আবার এ সংশোধনী উত্থাপন করা যাবে।’ জেবাল আমার কথা মেনে নিলেন। আমরা একটা সংকট থেকে রক্ষা পেলাম।

১৯৮২ সালের কথকতা by professor Farid Ahmed Reza

প্রশ্ন উঠতে পারে, এতোদিন পর এ সকল পুরানো কথা আলোচনার কী কোন প্রয়োজন আছে? আমার মতে অন্য কোন প্রয়োজন না থাকলেও ইতিহাসের একটা দায় আছে। সে দায় মুক্তির খাতিরেই এর অবতারনা।
৮২ সালের কোন এক সকাল। চায়ের বাক্স রিক্সায় তুলে সে বাক্সের উপর আমি উঠে বসলাম। রিক্সা চালককে বললাম, ‘চলো চলো, বন্দর চলো।’ বন্দর মানে বন্দর বাজার, সিলেট শহরের আদি ব্যবসা-বানিজ্যের কেন্দ্রস্থল।
ঢাকা থেকে সিলেট এসেছি। সদ্য বিয়ে করেছি। চাকরি নেই। টাকা পয়সা নেই। যারা এক সময় খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল তারাও এখন ঘনিষ্ট নয়। এক বন্ধু আবদুল কাইয়ূম। আরেক বন্ধু মকবুল আহমদ। এ দু জন সাহায্যের হাত প্রসারিত করলেন। তাদের সাহায্য ছাড়া সিলেট শহরে আমার দাঁড়াবার ঠাঁই হতো না। আল্লাহ তাদের ভালো কাজের পুরস্কার দিবেন। মকবুল আহমদের স্ত্রী মনোয়ারা আহমদের বড় ভাই মোহাম্মদ ফারুক মৌলভীবাজার শহরে চায়ের ব্যবসা করেন। মোহাম্মদ ফারুক চট্রগ্রাম থেকে নিলামে চা খরিদ করে আনেন। তিনি খরিদমূল্যে আমাকে চা সরবরাহ করতে সম্মত হলেন। আব্দুল কাইয়ূম দিলেন ব্যবসার পুজি। আম্বরখানা বাজারে একটা দোকান ভাড়া নিয়ে চা ব্যবসা শুরু করলাম। চা ব্যবসা মানে চয়ের দোকান নয়, চা-পাতার দোকান। সিলেট শহরে তখন বন্দর বাজার, মহাজনপট্টি এবং কালিঘাট ছিল ব্যবসার কেন্দ্র।
ফুট ফরমায়েশ এবং আমার অনুপস্থিতিতে দোকানে বসার জন্যে সামান্য বেতনে একটি ছেলে রাখলাম। ছেলেটির নাম বাবুল। বড়াপার পেছনের বাসায় থাকে, ভালো পরিবারের ছেলে। ফারুক ভাই নিলামে চা কিনে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। ১৫/২০টা চায়ের বাক্স এক সাথে পাঠাতেন। কয়েকটা বাক্স খুলে পলিথিনের প্যাকেট করে দোকানে সাজিয়ে রাখতাম খুচরা বিক্রির জন্যে। বাকিগুলো বন্দরবাজার, কালিঘাট এবং মহাজনপট্টির কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে অল্প লাভে বিক্রি করে দিতাম। তাদের কাছে চায়ের বাক্স রিক্সায় করে নিজেই নিয়ে যেতাম। কোন সময় বাবুলকে দিয়ে পাঠাতাম। চায়ের বাক্সের উপর বসে বন্দর বাজার, মহাজনপট্টি এবং কালিঘাটে চক্কর দেয়া প্রতি মাসের কাজ ছিল।
সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটতো। অপেক্ষা করতাম কখন সন্ধ্যা হবে। সন্ধ্যার পর ছোট্ট চায়ের দোকানে বন্ধুদের অনেকে আসতেন। তরুণ সাহিত্যকর্মীদের সাথে মুরব্বীরাও আসতেন। স্বানমধন্য গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দর আলী আসতেন। সিলেট আলীয়ার উস্তাদ মাওলানা জহুর আহমদ আসতেন। প্রায়ই আসতেন দুজন প্রিয় বন্ধু হারুনুজ্জামান চৌধুরী এবং আব্দুল হামিদ মানিক। দোকান বন্ধ করে বেরিয়ে পড়তাম তাদের সাথে আড্ডা দিতে। কখনো যেতাম চায়ের দোকানে গরম পিয়াজু অথবা হারুনুজ্জামান চৌধুরীর প্রিয় শিক কাবাব খেতে। কখনো যেতাম বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে। আব্দুল হামিদ মানিক তখন চাকরি করতেন মুকতাবিস-উন-নূরের সম্পাদনায় প্রকাশিত সিলেট কন্ঠে। হারুনুজ্জামান চৌধুরীছিলেন সাপ্তাহিক জালালাবাদ’র সম্পাদক। প্রধানতঃ এ দুটি পত্রিকার অফিসেই আমরা যেতাম। বাসায় ভালো খাবার থাকলে মাঝে মাঝে দু জনকে নিয়ে বাসায় চলে আসতাম।
সিলেট শহরে আমি অপরিচিত ছিলাম না। দীর্ঘদিন এ শহরে থেকে লেখাপড়া করেছি। রাস্তায় মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছি, বন্দর এবং কোর্ট পয়েন্টে বক্তৃতা করেছি। সাহিত্য সভায় কবিতা পড়েছি, সুধী সমাবেশে আলোচনা রেখেছি। শহরে অনেক বন্ধু, অনেক আত্মীয়-স্বজন এবং অনেক পরিচিত জন রয়েছেন। আমার অবস্থা দেখে কেউ মুখ টিপে হাসতো। কেউ রিক্সা থামিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করতো। কেউ হঠাৎ দেখে চমকে উঠতো। বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করতো, ‘রেজা ভাই? কবে এলেন?’
বলতাম, ‘আসিনি, আছি।’
– কোথায় আছেন?
– শাহী ঈদগাহ, সৈয়দ পুর হাউস।
– নিজের বাসা?
– না, দুলাভাইয়ের বাসা। তবে সৈয়দ পুর হাউস নামটা আমার দেয়া।
– সেই সুবাদে আছেন?
– না, তাদের অনেকগুলো বাসা আছে। একটিতে আমি ভাড়া থাকি।
– বাসায় কে কে আছেন?
– আমি আর আমার বউ। ছোটভাই ময়েজ। আম্মা-আব্বা মাঝে মাঝে আসেন।
– কি করেন?
– দেখছেন না কি করছি? আম্বরখানায় চা-পাতার ব্যবসা করি।
– চা-পাতার ব্যবসা!
– কেন, এটা কি দোষের? আমি কি চুরি করছি?
– না, চুরি নয়। তবে ব্যবসা করলে বড় কিছু করবেন। নতুবা বড় কোন চাকরি করবেন। সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকায় থাকবেন। সিলেটে আপনাকে মানায় না। ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রিয় নেতা আম্বরখানায় চা-পাতার ব্যবসা করবেন, এটা মেনে নেয়া যায় না।
– আপনি না মানলেও আমি মেনে নিয়েছি।
এ কথোপকথন কাল্পনিক নয়, বাস্তব। একবার নয়, বার বার এ সকল কথার জবাব দিতে হয়েছে। আমার বড়াপা একদিন বললেন,
– তোমার ভাগিনা কি বলে জানো?
– কি বলে?
সে বলে, ‘বড়মামা এতো লেখাপড়া করে চায়ের পাতার ব্যবসা করেন এটা বলতে লজ্জা লাগে।’
বন্ধুরা যা-ই বলুক এবং ভাগিনারা যা-ই ভাবুক, এ ভাবেই সিলেটে আমার নতুন জীবন শুরু হয়।
ঢাকার অনেক বন্ধুর কাছেও প্রশ্ন ছিল, কেন আমি সিলেট চলে এলাম? কেন ঢাকায় থাকলাম না? কিন্তু আমার কাছে এটা কোন প্রশ্নই ছিল না। সে সময় আমার কাছে বড় প্রশ্ন ছিল, কেন ঢাকায় এলাম? বাইরে ছিলাম, অনেক ভালো ছিলাম। অনেক স্বপ্ন ছিল, অনেক সুধারণা ছিল, অনেক আশা ছিল। ঢাকায় গিয়ে দীর্ঘদিন স্বযত্নে লালিত স্বপ্নসৌধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
আসলে আমার ঢাকায় আসার কথা ছিল না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। চট্টগ্রাম শহরের দায়িত্বে ছিলাম। এমএ পরীক্ষার শেষ দিন ইউনিভার্সিটি এপ্রোচে এসে ভার্সিটিকে সালাম জানিয়ে বলেছিলাম, বিদায় বিশ্ববিদ্যালয়, বিদায়! পাশ করলেও বিদায়, ফেল করলেও বিদায়। আর ছাত্র হিসেবে তোমার অঙ্গনে পা দেবো না। পাশ করলে সিলেটের কোন কলেজে মাস্টারি জোগাড় করে লেখালেখির জগতে চলে যাব। এমএ পাশ করতে না পারলে দেখবো সিলেটে কোন পত্রিকায় সুযোগ পাওয়া যায় কি না। বিয়ে করবো, মা-বাবার সাথে থাকবো, লেখালেখি করবো। কিন্তু এম এ পরীক্ষার ফল বের হবার আগেই সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেলো।